জান্নাতে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য অনন্তকাল
সূরা মুতাফফিনিনে আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা বলেন- "ইন্নাল আবরারা লাফিই নাঈম- পুণ্যবান লোকেরা থাকবে অফুরন্ত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের মাঝে।" عَلَی الۡاَرَآئِکِ یَنۡظُرُوۡنَ - "সুসজ্জিত আসনে বসে তারা দেখতে থাকবে।" অর্থাৎ, বিলাসবহুল চেয়ারে বা সিংহাসনে। আর তারা আরাম করে বসে থাকবে। রিল্যাক্স করবে। পাশ্চাত্য সমাজে যেমন বলা হয় 'লেজি বয় চেয়ার' বা অলস ছেলের চেয়ার। যে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে মানুষ রিল্যাক্স করে, চা কফি পান করে বা বই পড়ে। টিভি দেখে বা আড্ডা দেয়, যাই করুক। এটা হলো আরাম আয়েশের একেবারে খাঁটি আচরণ। আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা বলছেন যারা এই দুনিয়াতে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য কঠোর পরিশ্রম করতো পরের জীবনে তারা "আলাল আরা-ইকি ইয়ানজুরুন-সুসজ্জিত আসনে আয়েস করে বসে দেখতে থাকবে।" এরপর তিনি বলেন- تَعۡرِفُ فِیۡ وُجُوۡهِهِمۡ نَضۡرَۃَ النَّعِیۡمِ- "তুমি তাদের মুখে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের উজ্জ্বলতা দেখতে পাবে।" এই দুনিয়াতেও কেউ যদি ভালো খাবার আহার করে, মজার আলাপ-আলোচনা করে তাদের চোখ মুখ থেকেও কেমন যেন সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের দীপ্তি ছড়িয়ে পড়ে। সবকিছু ভালো যাচ্ছে। আলহামদুলিল্লাহ। আর জান্নাতে এই সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য অনন্তকাল ধরে চলতে থাকবে। یُسۡقَوۡنَ مِنۡ رَّحِیۡقٍ مَّخۡتُوۡمٍ - "তাদেরকে পান করানো হবে সীল-আঁটা উৎকৃষ্ট পানীয়।" এই পানীয় তাদের সরবরাহ করা হবে। আপনাকে উঠে গিয়ে নিয়ে আসতে হবে না। জান্নাতে আমাদের সেবা করার জন্য সেবক থাকবে। আল্লাহর বিশেষ এক সৃষ্টি। তারা ক্লান্ত হয়ে পড়ে না। আল্লাহ তাদেরকে জান্নাতী মানুষদের সেবক হওয়ার জন্য সৃষ্টি করেছেন। এটা তাদের কাজ। আর এতে তারা সন্তুষ্ট। আমি আগেও অনেকবার বলেছি, জান্নাতের কি এক বিস্ময়কর নেয়ামত এটি! আপনি একবার খাবেন এরপর আবার খাবেন, আবার খাবেন, আবার খাবেন শুধু খেতেই থাকবেন। এতে আপনার পেট যেমন পূর্ণ হয়ে যাবে না আবার ফুলেও উঠবে না। জান্নাতে মোটা হয়ে যাওয়ার কোনো ভয় নেই। কোনো ধরণের অনুশোচনা ছাড়াই আপনি খেতে পারবেন। বাঁচতে হবে বলে খাবেন না, খাবেন শুধু খাবারের স্বাদ উপভোগ করার জন্য। মজা পাওয়ার জন্য। কখনোই এমন হবে না, আমার পেট পূর্ণ হয়ে গেছে আর আহার করা সম্ভব নয়। আপনি মজার মজার সব খাবার আহার করবেন, করতেই থাকবেন। এটি জান্নাতের অন্যতম বড় একটি নিয়ামত। তো আল্লাহ বলেন-یُسۡقَوۡنَ مِنۡ رَّحِیۡقٍ مَّخۡتُوۡمٍ - "তাদেরকে পান করানো হবে সীল-আঁটা উৎকৃষ্ট পানীয়।" সবচেয়ে উৎকৃষ্ট কোয়ালিটির মদ তাদের পান করানো হবে। এখানে 'রাহিক' মানে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট কোয়ালিটির মদ। মদ সম্পর্কে আমি আসলে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। আমি জানি না কোন ধরণের পরিভাষা ব্যবহার করতে হবে। আর এরজন্য আল্লাহর প্রশংসা করছি। আমি দুআ করছি, আমরা যারা দুনিয়ার মদ পান থেকে নিজেদের বিরত রেখেছি, এর বিনিময়ে আল্লাহ যেন আমাদেরকে আখিরাতের মদের স্বাদ আস্বাদন করার তৌফিক দান করেন। خِتٰمُهٗ مِسۡکٌ - "এর শেষ ফোঁটা কস্তুরীর মতো সুগন্ধযুক্ত হবে।" অর্থাৎ, পানীয়টি আপনি পান করা শুরু করলেন, যত পান করতে থাকবেন এর স্বাদ তত বাড়তে থাকবে। আর যখন শেষ ফোঁটা পান করবেন এটা হবে পুরা ড্রিঙ্কসটার সবচে সুস্বাদু অংশ। وَ فِیۡ ذٰلِکَ فَلۡیَتَنَافَسِ الۡمُتَنَافِسُوۡنَ - "প্রতিযোগিতাকারীদের তো উচিৎ এ বিষয়ে প্রতিযোগিতা করা।" এই আকাঙ্ক্ষার জন্য, এই মজার জন্য, এই পুরস্কারের জন্য, এই আমোদপ্রমোদের জন্য, এই অমৃত স্বাদের জন্য, এই ককটেইলের জন্য...আল্লাহ বলছেন এটার জন্যই তোমাদের প্রতিযোগিতা করা উচিত। ও ক্ষণস্থায়ী এই দুনিয়ার মানুষেরা! তোমার প্রাসাদ আর ম্যানসনের পরোয়া করে কে। কয়েক দশকের মধ্যেই যা হারিয়ে যাবে। এই দুনিয়ার সকল আমোদপ্রমোদের কিইবা মূল্য আছে যার সবকিছুই ক্ষণিকের। আল্লাহ বলেছেন তুমি আসলেই কিছু করতে চাও? তাহলে পরবর্তী জীবনকে নিজের লক্ষ্য বানাও। জান্নাতকে নিজের লক্ষ্য বানাও। ঐ পানীয়টাকে নিজের লক্ষ্য বানাও। ঐ ড্রিংসের এক ফোঁটাও এ দুনিয়ার সকল ড্রিংকসের চেয়ে উত্তম। প্রতিযোগিতায় জয় লাভ করতে তোমার ভালো লাগে? তাহলে ঐ ড্রিংকসের জন্য প্রতিযোগিতা করো। - ড. ইয়াসির কাদি
কোমল স্বভাব: জান্নাতি মানুষদের বৈশিষ্ট্য
----------------------*-------------------
মুমিনের একটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হলো সে ঝামেলা তৈরি করে না। সে ক্ষুদ্রমনা নয়। এমন অনেককে হয়তো চিনে থাকবেন যার সাথে আপনি কোনো ধরনের কাজ কারবারে জড়াতে চান না। তারা ঝামেলা পাকাবে, উচ্চ আওয়াজে কথা বলবে, সামান্য ভুল ত্রুটিও মেনে নিবে না।
আবার, অন্য অনেককে চিনে থাকবেন যাদের সাথে কাজ কারবার করা অনেক সহজ। মুমিন হলো হাইয়িন বা কোমল। সে হলো জেন্টল বা নম্র-ভদ্র।
আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা কুরআনে এ বলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রশংসা করেন- فَبِمَا رَحۡمَۃٍ مِّنَ اللّٰهِ لِنۡتَ لَهُمۡ “অতঃপর আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমতের কারণে তুমি তাদের জন্য নম্র হয়েছিলে।” وَ لَوۡ کُنۡتَ فَظًّا غَلِیۡظَ الۡقَلۡبِ لَانۡفَضُّوۡا مِنۡ حَوۡلِکَ ۪- “আর যদি তুমি কঠোর স্বভাবের, কঠিন হৃদয়সম্পন্ন হতে, তবে তারা তোমার আশপাশ থেকে সরে পড়ত।” (3:159) অর্থাৎ, রাসূলুল্লাহ (স) যদি কঠোর স্বভাবের হতেন তাহলে সাহাবারা আশপাশ থেকে সরে পড়তো।
তিনি হলেন আমাদের রোল মডেল। তাই আমাদেরও উচিত নম্র এবং কোমল স্বভাবের হওয়া। সবার সাথে। বাছাই করা কিছু মানুষের সাথে নয়। আপনার স্বাভাবিক চরিত্র হলো আপনি ভদ্র এবং কোমল স্বভাবের।
যখন আল্লাহ তাআলা মূসা আলাইহিস সালামকে ফেরাউনের নিকট প্রেরণ করেন তখন তিনি কী বলেছিলেন? আল্লাহ বলেন - فَقُوۡلَا لَهٗ قَوۡلًا لَّیِّنًا - তার সঙ্গে নম্রভাবে কথা বলবে। (২০ঃ ৪৪)
মূসা আলাইহিস সালাম ফেরাউনের কাছে যাচ্ছেন আর আল্লাহ তাকে বলছেন ফেরাউনের সাথে নরম স্বরে কথা বলো। হয়তোবা সে উপদেশ গ্রহণ করবে অথবা ভয় করবে।
আমাদের স্বাভাবিক আচরণ হলো আমরা মানুষের সাথে নম্র এবং কোমল উপায় অবলম্বন করে আচরণ করব।
তিরমিজি শরীফের একটি হাদীসে আমাদের রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন—খুব সুন্দর একটি হাদিস, মনোযোগ দিয়ে শুনুন— "আমি কি তোমাদের এমন ব্যক্তির কথা বলব যাকে আল্লাহ জাহান্নামের জন্যে হারাম করেছেন এবং যার জন্য আল্লাহ জাহান্নাম হারাম করেছেন?" তিনি উভয় উপায়ের প্রতি গুরুত্বারোপ করেন। লোকটা জাহান্নামের জন্য হারাম এবং জাহান্নাম লোকটার জন্য হারাম। সাহাবারা জিজ্ঞেস করলেন কে সে ব্যক্তি? তিনি বলেন— كُلِّ قَرِيبٍ هَيِّنٍ لَيِّنٍ سَهْلٍ - "যে ব্যক্তি মানুষের কাছাকাছি (জনপ্রিয়), সহজ-সরল, নম্রভাষী ও সদাচারী।"
এমন প্রত্যেক ব্যক্তি যে নম্র-ভদ্র, সাহল বা যে ঝঞ্ঝাটঝামেলা থেকে মুক্ত, কারিব বা সে মানুষের কাছাকাছি থাকে। সে এমন ব্যক্তি যার সাথে আপনি সহজে আচার আচরণ করতে পারেন। যে কোনো ঝামেলা তৈরি করে না।
সুবহানাল্লাহ! আমরা নিজেদের সমাজেই এমন মানুষের সাথে পরিচিত। যারা অমায়িক এবং শান্ত স্বভাবের সবাই তাদেরকে পছন্দ করে। আর বিপরীত স্বভাবের মানুষের ধারেকাছেও কেউ যেতে চায় না।
[পরিবারের লোকজন আপনার কোমল আচরণ পাওয়ার বেশি হকদার। তাদের সাথে অমায়িক ব্যবহার করুন। অনেককে দেখেছি বাইরের মানুষের সাথে ভালো ব্যবহার করেন কিন্তু পরিবারের সদস্যদের সাথে কঠোর আচরণ করেন। এটা ঠিক না। তাদের ছোটখাটো ভুলত্রুটি উপেক্ষা করুন।]
—ড. ইয়াসির কাদি
Comments
Post a Comment