তাঁর অনুপম আচার-ব্যবহার
তাঁর অনুপম আচার-ব্যবহার। সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।— ড. ওমর সুলেইমান কুরআন অনেক স্থানে চরিত্রের কথা বলতে গিয়ে দেহের অঙ্গ ভঙ্গির উপর বেশ জোর প্রদান করেছে। বস্তুত, 'ইবাদুর রহমান' তথা রহমানের বান্দাদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহ্ প্রথমত কোন গুণের কথা উল্লেখ করেছেন। "আল্লাজিইনা ইয়ামশুনা আলাল আরদি হাওনা"—যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে। লোকমান হাকিম আলাইহিস সালাম যখন তাঁর সন্তানকে উপদেশ প্রদান করছিলেন, তখন তিনি গলার স্বর উঁচু করার বিষয়ে এবং পৃথিবীতে চলাফেরা করার নিয়ম নিয়ে কথা বলেছিলেন। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা পিতামাতার সাথে আচরণ করার সময় 'উফ' বলতেও নিষেধ করেছেন, বিরক্তি প্রকাশ বা তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে নিষেধ করেছেন। একই কথা আপনি রাসূল (স) এর হাদিসেও পেয়ে থাকবেন। রাসূল (স) বলেন, "কোনো মানুষ যেন চোখের খেয়ানত না করে।" অর্থাৎ, চোখ টেপা, বিশেষ ভঙ্গিতে তাকানো এবং কোনো ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করে তার অনুপস্থিতিতে এমনভাবে ভেংচি কাটা যা তার প্রতি বিশ্বাস ঘাতকতার ইঙ্গিত প্রদান করে। (এসব করা যাবে না।) যখন রাসূল (স) এর আচার-ব্যবহারের দিকে লক্ষ্য করবেন, রাসূল (স) এর দেহ ভঙ্গির সবকিছুই ছিল নবুয়তী মর্যাদার সাথে মানানসই। সবার আগে— আপনারা হয়তো এই ধারণার সাথে পরিচিত নন যে, কীভাবে একজন মানুষ এতো সুন্দর হওয়া সত্ত্বেও এতোটা লাজুক হতে পারেন! কিন্তু রাসূল (স) বলেন, ইসলামের খুলুক তথা ইসলামের চরিত্র, ইসলামের স্বতন্ত্র গুণ হলো লজ্জাশীলতা। যদি রাসূল (স) এর দিকে তাকান— তিনি ছিলেন সবচেয়ে লাজুক, মানুষের মাঝে সবচেয়ে সলজ্জ ব্যক্তি। যদিও তাঁর ছিল সর্বোৎকৃষ্ট চারিত্রিক গুণাবলী। সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। কোন ধরণের গুণাবলী ছিল তাঁর? কেমন ছিল তাঁর আচার-ব্যবহার? আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালাম। আমরা ইতোমধ্যে বলেছি, তাঁর মুখে সর্বদা মুচকি হাসি লেগে থাকতো। তাঁর বর্ণনা দেওয়া হয়েছে যে, তিনি ছিলেন 'বাসসামান' 'দহহাকান'— তিনি সবসময় মৃদু হাসতেন এবং অন্যদেরও মৃদু হাসাতেন। তিনি জোরে হাসতেন এবং অন্যদেরও জোরে হাসাতেন। কিন্তু তাঁর জোরে হাসিটাও (আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালাম) ছিল মর্যাদাপূর্ণ এবং সলজ্জ। তিনি যখন জোরে হাসতেন (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তা ছিল মূলত খুবই প্রশস্ত একটি মুচকি হাসি। তিনি এমনভাবে হাসতেন তাঁর মুচকি হাসিটা এতো বড় হত যে আপনি তাঁর দাঁতের গোড়ালি পর্যন্ত দেখতে পেতেন। সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। এমনকি যখন তিনি হাসার ইচ্ছে করতেন (আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালাম) সেটাও তাঁর সম্পর্কে একটি বার্তা প্রদান করে। তিনি অন্যদের সাথে হাসতেন। কিন্তু তিনি তখনো হাসতেন (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)—তাঁর মুচকি হাসিটাকে একটু প্রশস্ত করে— যখন আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তাঁকে কোনো সুসংবাদ প্রদান করতেন। আলী ইবনে আবি তালিব (রা) উল্লেখ করেন— রাসূলুল্লাহ (স) কোনো ইবাদাত শেষ করার পর তাঁর মুখে প্রশস্ত হাসির ঝলক দেখা যেতো। তিনি তখনো হাসতেন যখন তিনি আল্লাহর করুণা নিয়ে কথা বলতেন। ঐ ব্যক্তি সম্পর্কে বিখ্যাত বর্ণনার কথা আমরা সবাই জানি, যিনি সবার শেষে জান্নাতে প্রবেশ করবেন। ঐ লোক মনে করবে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তাঁর সাথে কৌতুক করছেন। কারণ, সে আল্লাহর সীমাহীন করুণা এবং উদারতার ব্যাপারটা হৃদয়ঙ্গম করতে পারবে না। এটা বলার সময় রাসূলুল্লাহ (স) হাসলেন এবং বললেন, আল্লাহ্ লোকটির কথায় হাসবেন, যখন লোকটি বলবে, ইয়া আল্লাহ্! আপনি কি আমার সাথে মজা করছেন! আর আপনি হলেন মহাবিশ্বের প্রভু। তাঁর হাসির আওয়াজ শোনা যেতো না। কিন্তু এই হাসিটা তাঁর সবসময়ের হাসি থেকে স্বতন্ত্র ছিল। সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। আর এতে তাঁর দাঁতের গোড়ালি দৃষ্টিগোচর হতো। রাসূলুল্লাহ (স) আরও পরিচিত ছিলেন দীর্ঘ সময়ের জন্য নিশ্চুপ থাকার জন্য। মাঝে মাঝে হয়তো দেখে থাকবেন— কোনো ব্যক্তি যখন বাকপটু, শক্তিশালী, সুন্দর হয় বা এরকম অন্যান্য গুণে গুণী হয়, সে ব্যক্তি তখন প্রতিটি আড্ডায় অধিকতর প্রভাব বিস্তার করে, প্রতিটি কথোপকথনে সবাইকে ছাপিয়ে যায়। ইনি হলেন আল্লাহর রাসূল। সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। আর তিনি প্রসিদ্ধ ছিলেন তাঁর নীরবতার জন্য। তিনি সর্বদা চিন্তামগ্ন থাকতেন। আপনি তাঁর দিকে তাকালেই বুঝতে পারতেন (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), তিনি ছিলেন গভীরভাবে উপলব্ধির ক্ষমতাসম্পন্ন। যখন তিনি কোনো জমায়েতে বসতেন, তখন কেবল সেভাবেই কথা বলতেন (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যা ঐ জমায়েতের জন্য উপযুক্ত ছিল। তাঁর আরও বর্ণনা দেওয়া হয়েছে— তাঁর কথাগুলো ছিল দারুণ যুক্তিপূর্ণ এবং সুসংহত। তিনি যখন কথা বলতেন— যথাযথ কথা বলতেন। আমরা আগে যেমন বলেছি তাঁর উচ্চারণগুলো ছিল ঝরঝরে। তিনি ধীরে ধীরে কথা বলতেন। কোনো কোনো কথা কয়েকবার বলতেন। সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তাই, তাঁর সকল কথা আপনি সাথে সাথে বুঝতে পারতেন এবং তাঁর কাছ থেকে স্মরণে রাখতে পারতেন। সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তাঁর অসাধারণ সৌন্দর্য থাকা সত্ত্বেও তিনি সাধারণত দৃষ্টি নিম্নগামী করে রাখতেন। আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালাম। তিনি যখন মানুষের দিকে তাকাতেন— তিনি আপনার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেন না, এক পলক তাকিয়েই আবার দৃষ্টি নিম্নগামী করে নিতেন। সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। এটা তাঁর বিনম্রতার অংশ। তৎসত্ত্বেও, আপনি যদি তাঁর সাথে দৃষ্টি সংযোগ উপভোগ করতেন তাহলে তিনি তা বজায় রাখতেন। কিন্তু আপনি যদি তাঁর দৃষ্টি দ্বারা ভীত হয়ে পড়তেন, তাহলে তিনিও তাঁর দৃষ্টি সরিয়ে নিতেন। সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তাঁর চারিত্রিক সৌন্দর্য এতোটাই বিস্ময়কর ছিল! আমর ইবনে আস (রা) বলেন, আপনারা যদি আমাকে তাঁর বর্ণনা দিতে বলেন, আমি তা দিতে পারবো না। যদিও আমি একেবারে তাঁর সম্মুখে উপস্থিত থাকতাম, আমি তাঁর দিকে তাকাতে পারতাম না। ইজলালান ওয়া তা'জিমান। তাঁর উপস্থিতির সম্মানজনক ভীতির কারণে। তাঁর অস্বাভাবিক সৌন্দর্যের কারণে। সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধের কারণে। আমি চোখ তুলে তাঁর দিকে তাকাতে পারতাম না। সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। রাসূলুল্লাহ (স) যখন আপনার দিকে ফিরতেন, আপনার কথা বলার সময়— মানুষের প্রতি মনোযোগ দেওয়ার ক্ষেত্রেও রাসূল (স) ছিলেন অসাধারণ— "ইজাল তাফাতা" যখন তিনি ফিরতেন (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), তিনি শুধু আপনার দিকে তাঁর মাথা ফিরাতেন না, তিনি তাঁর সমগ্র শরীর আপনার দিকে ফিরাতেন। সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। আপনাকে বুঝাতে যে, ঐ মুহূর্তে তিনি শুধু আপনার কথাই শুনছেন। যদি তাঁকে কিছু শোনাতে চাইতেন, তিনি আপনার কথা দারুণ মনোযোগ দিয়ে শুনতেন এবং তিনি আপনার দিক থেকে তাঁর কান সরাতেন না, যতক্ষণ না আপনার সমস্ত কথা বলা শেষ হয়। আর যদি তাঁর সাথে করমর্দন করতেন, রাসূল (স) তাঁর হাত ছাড়িয়ে নিতেন না যতক্ষণ না আপনি আপনারটা ছাড়িয়ে নিতেন। আপনাকে জানাতে যে, তিনি শুধুই আপনার জন্য যতক্ষণ আপনি তাঁর সাথে কথা বলছেন। সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। এ বিষয়ে আমার অন্যতম প্রিয় একটি বর্ণনা হলো... আমাদের মোবাইল ফোন ব্যবহারের ক্ষেত্রে যা খুবই প্রাসঙ্গিক। রাসূল (স) এর খুবই প্রিয় একটি আংটি ছিল। আংটিটি ছিল রুপোর তৈরি। আবিসিনিয়া থেকে আনা একটি রুবি পাথর এর উপরে খোদাই করা ছিল। একবার রাসূল (স) এই আংটিটি পরিহিত অবস্থায় ছিলেন। কথোপকথনের সময় তিনি আংটিটির দিকে কয়েকবার তাকালেন। তাঁর সাহাবীদের সাথে কথা বলার সময় আংটিটির কারণে মনোযোগে বিঘ্ন ঘটায় তিনি নিজের প্রতি নাখোশ হয়ে পড়েন। সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তিনি তখন আঙুল থেকে এটি খুলে ফেললেন এবং সরিয়ে রাখলেন। আর বললেন, আমি এই আংটির দিকে কয়েকবার তাকিয়েছিলাম, তাই আমি এটি সরিয়ে ফেলতে চেয়েছি। কারণ, এটি তোমাদের থেকে আমার মনোযোগ নষ্ট করে ফেলছিল। সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তিনি যদি আপনার দিকে ইঙ্গিত করতে চাইতেন (আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালাম), তিনি আঙুল ব্যবহার করতেন না। কারণ, যদি আপনার দিকে আঙুল তুলে নির্দেশ করতেন আপনার হয়তো মনে হতে পারে তিনি আপনাকে দোষারোপ করছেন। তাই, রাসূল (স) তাঁর সমস্ত হাত উঠিয়েই কেবল ইঙ্গিত করতেন। যেন এমনটি মনে না হয় যে, তিনি আঙুল তুলে আপনাকে দোষারোপ করছেন। সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। ইজা তায়াজ্জাবা— রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন কোনো কিছুতে আশ্চর্যান্বিত হয়ে যেতেন অথবা তাঁর সম্মুখে মজাদার কিছু বলা হতো, রাসূলুল্লাহ (স) তার রানের উপর মৃদু স্পর্শ করে বলতেন সুবহানাল্লাহ, সুবহানাল্লাহ। রাসূলুল্লাহ (স) যখন হাঁটতেন... তিনি এমন মানুষ ছিলেন যিনি উদ্দেশ্য নিয়ে হাঁটতেন। আলী (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (স) এর হাঁটা ছিল এমন যেন এক ব্যক্তি উচুঁ কোনো জায়গা হতে নিচে নামছেন৷ আবু হুরাইরা (রা) বলেন, আপনি এমনকি তাঁর সাথে গতি বজায় রাখতে পারতেন না। কারণ, রাসূল (স) এর হাঁটা ছিল এমন ব্যক্তির হাঁটার মত যিনি গুরুত্বপূর্ণ কিছু করার জন্য ছুটে চলছেন। তিনি দাম্ভিকতার সাথে হাঁটতেন না। সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। আবার অলসতার সাথেও নয়। কিন্তু, তিনি দ্রুত হাঁটতেন। তিনি যে সর্বদা অনুপ্রাণিত এটি তার প্রতি নির্দেশ করতো। তিনি সবসময় ভালো কিছু করার মাঝে ব্যস্ত ছিলেন। সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। এমনকি তাঁর বসার আদবেও আপনি বিনম্রতা দেখতে পাবেন। এতে ছিল ইচ্ছাকৃত নম্রতা। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা রাসূল (স) এর নিকট একজন ফেরেশতা পাঠিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তিনি কি তাঁর জীবন একজন 'নাবিইয়ান মালিকা' হিসেবে কাটাতে চান নাকি 'নাবিইয়ান আব্দা' হিসেবে? এমন একজন নবী হিসেবে যিনি রাজার মত জীবন যাপন করেন নাকি এমন একজন নবী হিসেবে যিনি বিনয়ী দাসের মত জীবন যাপন করেন? রাসূল (স) পছন্দ করলেন 'নাবিইয়ান আব্দা'— একজন বিনয়ী দাসের মত জীবন। এবং তিনি বলেন, এই কারণে তিনি সবসময় সোজা হয়ে বসে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একটি নির্দিষ্ট উপায়ে তাঁর আহার গ্রহণ করতেন। হেলান দিয়ে নয়— একজন অহংকারী ব্যক্তির ন্যায়, একজন সম্পদশালী ব্যক্তির ন্যায় বা একজন রাজার ন্যায়। সুতরাং, রাসূল (স) তাঁর আচার-আচরণের বেলায় যা কিছু করেছিলেন সবকিছুই প্রমাণ করে তাঁর তুলনাহীন নম্রতার, তাঁর শালীনতার, তাঁর সচ্চরিত্রতার, তাঁর লজ্জাশীলতার এবং তাঁর আন্তরিকতার আল্লাহ্ এবং মানুষের প্রতি। সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।
Comments
Post a Comment