জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত সাহাবি সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস (রা.)
প্রখ্যাত সাহাবি হজরত সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস (রা.)। নবিজি (সা.)-এর খুবই প্রিয় একজন সাহাবি। তার সবচেয়ে মর্যাদার বিষয়-তিনি আশারায়ে মুবাশশারা তথা দুনিয়াতেই জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত দশজন সাহাবির অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।
ইসলামের শুরুর যুগে সতেরো বছর বয়সে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। কেউ কেউ তাকে ইসলামের সতেরোতম ব্যক্তি হিসাবেও অভিহিত করেন।
৬৪৬ ও ৬৫১ সালে তাকে কূটনৈতিক দায়িত্ব দিয়ে চীনে পাঠানো হয়। ধারণা করা হয়, নৌরুটে চীন যাওয়ার পথে তিনি চট্টগ্রাম বন্দরে থেমেছিলেন। এ সময় বাংলা অঞ্চলকে ইসলামের সঙ্গে পরিচয় করানোর ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকাও রেখেছিলেন।
প্রবল ধারণামতে, তিনি ৬৪৮ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের লালমনিরহাটে একটি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন, যা স্থানীয়ভাবে ‘আবু আক্কাস মসজিদ’ নামে পরিচিত। চীনা মুসলিমদের মতে, চীনের ক্যান্টন বন্দরে তার কবর। তবে আরবদের মতে তার কবর আরবেই অবস্থিত।
এছাড়া তিনি ইসলামের ইতিহাসে প্রথম তির নিক্ষেপকারী ছিলেন। মদিনায় হিজরতের পর প্রথম বছরই নবিজি (সা.) ৬০ জন সাহাবির একটি দল আবু সুফিয়ানের একটি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। এটি ছিল ইসলামের প্রথম সারিয়া। ‘রাগিব’ নামক স্থানে গিয়ে দুই পক্ষের মাঝে তির ছোড়াছুড়ি হয়। তখন মুসলিম বাহিনী থেকে সর্বপ্রথম তীর নিক্ষেপ করেন হজরত সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস (রা.)।
ইসলামের ইতিহাসে তার একটি চমৎকার ঘটনা উল্লেখ আছে। তখন হজরত উমর (রা.)-এর খেলাফত চলমান। হজরত সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস (রা.) বসরার শাসক। একবার সেখানকার কিছু দুষ্ট লোক উমর (রা.)-এর কাছে তার নামে কিছু মিথ্যা অভিযোগ করে। এমনকি তার নামাজ আদায়ের ব্যাপারে শৈথিল্যের অভিযোগ পর্যন্ত করার দুঃসাহস দেখায়।
হজরত উমর (রা.) সাদ (রা.)কে ডেকে আনীত অভিযোগ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। এসব শুনে তিনি খুবই মনঃক্ষুণ্ন হন। প্রথমে তিনি অভিযোগগুলোর খণ্ডন করেন।
এরপর ইসলামের জন্য বিভিন্ন সময়ে তার ত্যাগ-তিতিক্ষা ও কষ্ট-মুজাহাদার কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘আমি ইসলামের প্রথম ব্যক্তি, যে কাফেরদের রক্ত প্রবাহিত করেছে। আমি প্রথম ব্যক্তি, যে আল্লাহর রাস্তায় তির নিক্ষেপ করেছে। আমরা মুহাম্মাদ (সা.)-এর সাহাবিরা এমন অবস্থায় যুদ্ধ করেছি, গাছের বাকল ও পাতা ছাড়া কিছুই খেতে পেতাম না। এসব খাওয়ার ফলে আমাদের মুখে ঘা হয়ে গিয়েছিল। এমনকি উট ও বকরির মতো মলত্যাগ করতাম। তা সত্ত্বেও বনু আসাদের লোকরা দ্বীন সম্পর্কে আমাকে অভিযুক্ত করেছে। দ্বীন সম্পর্কে যদি আমি অজ্ঞই হই, তবে তো আমার সব আমলই বরবাদ হয়ে গেল। [সহিহ বুখারি-৩৭২৮; শামায়েলে তিরমিজি-৩৭৪; শারহুস সুন্নাহ-৩৯২৩]।
তিনি আরও বলেন, এদের অভিযোগ, আমি ঠিকমতো নামাজ আদায় করি না। আমি তো নবিজি (সা.)কে যেভাবে নামাজ পড়তে দেখেছি, ঠিক সেভাবেই নামাজ পড়ি। বিন্দুমাত্র ত্রুটি করি না তাতে।
তখন হজরত উমর (রা.) ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও সরেজমিন পরিদর্শনে দুজন ব্যক্তিকে বসরায় প্রেরণ করেন। তারা সেখানের প্রতিটি অলিগলি, ঘরবাড়ি ও মসজিদ ঘুরে সত্যতা যাচাই করে। সবাই সাদ (রা.)-এর উচ্চ প্রশংসা ও পক্ষাবলম্বন করে। একজন মাত্র লোক তার বিরুদ্ধে বলে।
সে তিনটি অভিযোগ করে-সাদ জীবনের মায়ায় পড়ে জিহাদ থেকে দূরে থাকে। মানুষের মাঝে সমানভাবে অর্থ-সম্পত্তি বণ্টন করে না। ন্যায়বিচার করে না। হজরত উমর (রা.) এ ঘটনা জানতে পেরে দুঃখ-ভারাক্রান্ত মনে তার জন্য তিনটি বদদোয়া করেন-আল্লাহ! এ লোকের জীবন তুমি দীর্ঘ করে দাও! দারিদ্র্যের কষ্ট তাকে ভোগ করাও! তাকে ফেতনায় নিপতিত করো!
হজরত সাদ (রা.)-এর বদদোয়া আল্লাহ কবুল করেছিলেন। বার্ধক্যে তার অবস্থা অনেক শোচনীয় হয়েছিল। ভ্রুর চামড়া চোখের ওপর ঝুলে পড়েছিল। রাস্তায় ঘুরে ঘুরে ভিক্ষা করত আর যুবতী মেয়েদের উত্ত্যক্ত করত। কেউ তার এ দুরবস্থার কথা জিজ্ঞেস করলে বলত, আমার গায়ে সাদের বদদোয়া লেগেছে!
তথ্যসূত্র : আল মাওয়াহিবুল ইলাহিয়্যা-৭৩৩
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন