রমজানকে বরণ করুন

 


রমজানকে বরণ করুন: নিজের সর্বোত্তম রূপের দিকে যাত্রা শুরু করুন

-------------- * ------------------ * ----------------------- রমজানের আগমনী আভাস যতই ঘনিয়ে আসছে, বাতাসে এক ধরনের নীরব উচ্ছ্বাস অনুভূত হচ্ছে—অপেক্ষার একটি পবিত্র অনুভূতি, যা অন্য যেকোনো মাস থেকে আলাদা। চাঁদের সরু রেখা খুব শীঘ্রই আকাশে উদিত হবে যা করুণা, পরিবর্তন এবং অতুলনীয় সুযোগে পূর্ণ এক পবিত্র সময়ের সূচনা করবে। রমজান শুধু ক্যালেন্ডারের একটি মাস নয়; এটি আপনার জীবনের উদ্দেশ্যকে পুনরায় আবিষ্কার করার, আপনার আত্মাকে নবায়ন করার এবং আল্লাহ্ আপনাকে যেমন দেখতে চান, সেই সর্বোত্তম রূপের কাছাকাছি পৌঁছানোর এক ঐশ্বরিক আমন্ত্রণ। আপনি কি এই রমজানকে আপনার জীবনের সেরা রমজান হিসেবে গড়ে তোলার জন্য প্রস্তুত? এক নতুন পথচলার সূচনা আপনার অপেক্ষায় ----------------------------------------------- ভাবতে পারেন? প্রতিটি সকালে নিষ্পাপ একটি আমলনামা নিয়ে জেগে উঠছেন— অতীতের বড় বড় ভুলগুলো ছেড়ে এসে আপনি এমন এক মাসে প্রবেশ করছেন, যেখানে প্রতিটি ভালো কাজ অন্য মাসের তুলনায় বহুগুণে সমুজ্জ্বল হয়ে উঠবে। রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “যে ব্যক্তি ঈমান ও সওয়াবের আশায় রমজানের রোজা রাখে, তার পূর্ববর্তী গুনাহগুলো ক্ষমা করে দেওয়া হবে” (সহীহ আল-বুখারী)। এটি শুধু ক্ষমার প্রতিশ্রুতি নয়; বরং কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান। রমজান আপনাকে একটি রিসেট বাটনে চাপ দেওয়ার সুযোগ দেয়—একটি সুবর্ণ সুযোগ পুরনো বাজে অভ্যাসগুলো ত্যাগ করার, ভাঙা সম্পর্কগুলো মেরামত করার এবং আন্তরিকতার সাথে আল্লাহর দিকে ফিরে আসার। এটাকে আত্মার জন্য বসন্তকালীন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার সময় হিসেবে ভাবুন। যেভাবে আপনি ঘরকে পরিষ্কার করেন, রমজান হলো আপনার আত্মাকে পরিষ্কার করার সময়। পুরনো অভিমানগুলো ভুলে যান, সব ধরনের গোলযোগ থেকে দূরে থাকুন এবং শান্তির জন্য নিজেকে প্রস্তুত করুন। এটি নতুনভাবে শুরু করার অপার সুযোগ। আর জেনে রাখুন, আল্লাহর রহমত আপনাকে আলিঙ্গন করার জন্য অপেক্ষারত। লুকানো রত্নের এক মাস ----------------------- রমজান শুধু সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত উপবাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়—এটি একটি সম্পদে ভরা সিন্দুক, যা আপনার খোলার অপেক্ষায় আছে। এই ৩০ দিনের মধ্যে রয়েছে গভীর সৌন্দর্যের বহু মুহূর্ত: সেহরির সময়ের নিস্তব্ধতা যখন পুরো পৃথিবী ঘুমিয়ে থাকে, প্রিয়জনের সাথে ইফতারের আনন্দ, এবং রাতের আকাশের নিচে নামাজে দাঁড়ানোর প্রশান্তি। তারপর আছে লাইলাতুল কদর, এতই শক্তিশালী এক রাত—যা এক জীবনের ইবাদতের চেয়েও বেশি মূল্যবান। কুরআনে এটিকে "হাজার মাসের চেয়েও উত্তম" বলা হয়েছে (কুরআন ৯৭:৩)। কল্পনা করতে পারেন সেই রাতটি পেয়ে যাওয়ার সওয়াব? রমজানের প্রতিটি মুহূর্তই আখিরাতের জন্য গুপ্তধন সংগ্রহ করার সুযোগ। কারো সাথে সদয় ব্যবহার, ভালোবাসা নিয়ে কুরআনের একটি আয়াত তিলাওয়াত, ভোর রাতে নীরবে দোয়া করা—প্রতিটি কাজই আমাদের কল্পনার চেয়েও অনেক বেশি সওয়াবের। রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “সবচেয়ে উত্তম আমল হলো যা নিয়মিত করা হয়, তা ছোট হলেও” (সহীহ মুসলিম)। আপনাকে নির্ভুল হতে হবে না; শুধু আন্তরিক হৃদয় নিয়ে এগিয়ে আসুন। আপনার কল্পনার চেয়েও আপনি অনেক বেশি সামর্থ্যবান --------------------------------------------------------- রোজা রাখা কঠিন মনে হতে পারে—দীর্ঘ সময় ধরে খাবার ও পানি ছাড়া থাকা, বিশেষ করে যখন আপনি কাজ, পরিবার বা অন্যান্য দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। কিন্তু এখানে একটি বিষয় আছে। রমজান কিন্তু আপনি কী ত্যাগ করছেন, তা নিয়ে নয়; বরং আপনি কী অর্জন করছেন, তা নিয়ে। আপনার ভেতরে আল্লাহ্ যে শক্তি রেখেছেন, তা আবিষ্কার করার সময় হলো রমজান। যখন আপনার পেট গুড়গুড় করে বা গলা শুকিয়ে আসে, তখন আপনি দুর্বল নন—বরং আপনি আপনার সহনশীলতা, আপনার ইবাদত এবং সাধারণের চেয়ে উঁচুতে ওঠার ক্ষমতা দেখাচ্ছেন। নবীজির (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহাবীদের কথা ভাবুন। তারা প্রচণ্ড গরমে রোজা রাখতেন, কখনও শুধু খেজুর ও পানি দিয়ে সময় কাটাতেন, কিন্তু এতে তাদের ঈমান আরও শক্তিশালী হতো। আপনি সেই ঐতিহ্য বহন করছেন। রমজান হলো আপনার আধ্যাত্মিক শক্তি বাড়ানোর এবং আরও বেশি সুশৃঙ্খল ও আল্লাহর সাথে সংযুক্ত হওয়ার সুযোগ। চিরস্থায়ী সওয়াবের বীজ বপন করুন ------------------------------------ এই রমজানে আপনার প্রতিটি প্রচেষ্টা যদি এমন একটি উপহার হয়, যা দীর্ঘকাল ধরে ফল দেয়? কল্পনা করুন: আপনি কারো প্রয়োজনে এক বেলা খাবার দিলেন, এবং সেই ভালো কাজটি রমজান শেষ হওয়ার পরও তাদের ও আপনার জীবনে প্রভাব ফেললো। অথবা আপনি একটি নতুন সূরা মুখস্থ করলেন, এবং এর বাণী ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জগুলোতে আপনাকে পথ দেখালো। রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদের সদকায়ে জারিয়ার কথা শিখিয়েছেন—যেমন কাউকে একটি দোয়া শেখানো বা একটি কূপ নির্মাণে সাহায্য করা। এগুলো হলো সেই বীজ, যা আপনি রমজানে বপন করেন এবং যা চিরস্থায়ী সওয়াবে পরিণত হয়। এই মাসে বড় স্বপ্ন দেখার সাহস করুন। এমন লক্ষ্য নির্ধারণ করুন যা আপনার সামর্থ্যকে সম্প্রসারিত করবে: কুরআন খতম করা, প্রতিটি সালাত সময়মতো আদায় করা, আগের চেয়ে বেশি দান করা। এমনকি যদি আপনি হোঁচট খান, আল্লাহ্ আপনার প্রচেষ্টা দেখেন। তিনি বলেছেন, “যে ব্যক্তি অণু পরিমাণ ভালো কাজ করবে, সে তা দেখতে পাবে” (কুরআন ৯৯:৭)। আপনার ছোট্ট পদক্ষেপগুলোরও মূল্য আছে—কারণ রমজানে সেগুলো সেই সত্তার দ্বারা বৃদ্ধি পায়, যিনি কোনো ভালো কাজই অবহেলা করেন না। চূড়ান্ত পুরস্কার যা নিরস মনে অনুপ্রেরণার জোয়ার নিয়ে আসে ------------------------------------------------------------ চোখ বন্ধ করে জান্নাতের কথা ভাবুন: দুধ ও মধুর নদী, সবুজের অফুরন্ত উদ্যান, এমন এক শান্তি যা সকল দুঃখ-কষ্ট মুছে দেয়। রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একে এমন একটি স্থান হিসেবে বর্ণনা করেছেন, “যেখানে কোনো ক্লান্তি বা পরিশ্রম নেই” (সহীহ মুসলিম)। এটি হলো সেই চূড়ান্ত লক্ষ্য, যার দিকে রমজান আপনাকে ধীরে ধীরে এগিয়ে নিয়ে যায়। প্রতিটি রোজা, দোয়ায় ঝরানো প্রতিটি অশ্রু, ধৈর্যের প্রতিটি মুহূর্ত জান্নাতের বিভিন্ন নেয়ামতে রূপান্তরিত হবে। স্বর্ণ দিয়ে নির্মিত একটি প্রাসাদ, একটি ঝর্ণা, একটি বাগান। আরও কত কি! প্রাসাদের চূড়ায় দাঁড়িয়ে যেদিকে তাকাবেন শুধু দেখবেন নেয়ামত আর নেয়ামত। আর সবকিছু শুধুই আপনার। আর সবচেয়ে বড় পুরস্কার? আল্লাহকে সরাসরি দেখার সুযোগ। কুরআনে বলা হয়েছে, “সেদিন কিছু মুখমণ্ডল উজ্জ্বল হবে, তাদের রবের দিকে তাকিয়ে থাকবে” (কুরআন ৭৫:২২-২৩)। এই দৃশ্যটি আপনার হৃদয়ে অনুপ্রেরণার এক আগুন জ্বালিয়ে দিক। এই রমজানে আপনি শুধু রোজা রাখছেন না—আপনি এমন একটি পুরস্কারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন, যা মানুষের বুদ্ধিতে পুরোপুরি বুঝা সম্ভব নয়। আপনার রমজান, আপনার পথ -------------------------------- তাহলে, আপনি কীভাবে এই রমজানকে আপনার করে তুলবেন? ছোট থেকে শুরু করুন কিন্তু বড় স্বপ্ন দেখুন। হতে পারে সেহরির আগে আল্লাহর সাথে কথা বলার জন্য ১০ মিনিট আগে ঘুম থেকে উঠা। হতে পারে বেশি মুচকি হাসা, কম অভিযোগ করা বা এমন কারো সাথে যোগাযোগ করা যার সাথে আপনার সম্পর্ক দুর্বল হয়ে গেছে। তিনটি লক্ষ্য লিখুন—সহজ কিন্তু অর্থপূর্ণ—এবং সেগুলো এমন জায়গায় রাখুন যেখানে আপনি প্রতিদিন সেগুলো দেখবেন। নিজেকে বলুন: এটি আমার মাস। এটি আমার সুযোগ। আপনাকে আলেম বা সাধু হতে হবে না। আপনাকে শুধু আপনিই হতে হবে—ত্রুটিপূর্ণ কিন্তু আশাবাদী এবং চেষ্টাশীল। আল্লাহ্ আপনার কাছ থেকে নিখুঁত হওয়ার প্রত্যাশা করেন না। তিনি আপনার হৃদয় চান। তিনি বলেছেন, “তোমরা আমাকে ডাকো, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব” (কুরআন ৪০:৬০)। এই রমজানে তাঁকে ডাকুন। আপনার ভয়, আপনার স্বপ্ন, আপনার কৃতজ্ঞতা তাঁর কাছে উজাড় করে দিন। তিনি শুনছেন, এবং তিনি আপনার কল্পনার চেয়েও কাছাকাছি। বরকতের দিকে এগিয়ে যান ---------------------------- রমজান আপনার দরজায় কড়া নাড়ছে, রহমত ও ভালোবাসা নিয়ে তার হাত প্রসারিত। এটাকে আপনার পাশ কাটিয়ে যেতে দেবেন না। এই মাসটি সবকিছু বদলে দিতে পারে—এই মাসটি হতে পারে এমন মাস যেমাসে ঈমানের মিষ্টতা অনুভব করবেন, এই মাসটি হতে পারে আল্লাহর দিকে যাত্রার মোড় পরিবর্তনের সূচনা। আপনি পারবেন। আপনার আত্মা প্রস্তুত, আপনার হৃদয় ইচ্ছুক, এবং আল্লাহ্ অপেক্ষা করছেন। তাই, একটি গভীর নিঃশ্বাস নিন, দুয়ার জন্য হাত তুলুন এবং রমজানকে ‘হ্যাঁ’ বলুন। সমৃদ্ধি, আনন্দ এবং জান্নাতকে ‘হ্যাঁ’ বলুন। আপনার আলোকিত হওয়ার শ্রেষ্ঠ সময় এই রামাদান। অন্তর থেকে বলুন-- “হে আল্লাহ্, আমাদেরকে রমজান পর্যন্ত পৌঁছে দিন এবং এ মাসটিকে বরকত, ক্ষমা ও আপনার নৈকট্যের মাস করুন। আমীন।”

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সহজ দশটি(১০)টি জিকির!

❝সূরা হুজুরাত❞

নিশ্চয়ই কষ্টের সাথেই স্বস্তি আছে