রমজানে মহানবীর (সা.) দানশীলতা
রমজানে দানের গুরুত্ব এত বেশি যে, অনেক আলেমের মতে, রমজানের উপাদান তিনটি—এক. দিনে রোজা রাখা, দুই. রাতে ইবাদত করা, যাকে ‘কিয়ামুল লাইল’ বলে, এবং তিন. দান ও সেবামূলকজ কাজ করা।
আজকাল আমরা রমজানে জনকল্যাণমূলক কাজ এড়িয়ে কেবল ব্যক্তিগত ইবাদতে মগ্ন থাকি এবং দান-সদকা থেকে হাত গুটিয়ে রাখি। এর মাধ্যমে প্রকারান্তরে রমজানের এই তৃতীয় উপাদানকে অবহেলা করা হয়। অথচ নবীজির (সা.) আদর্শ হলো, রমজানে দানের পরিমাণ বাড়ানো। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) মানবকুলের মধ্যে সর্বাধিক দানশীল ছিলেন। রমজান মাসে যখন জিবরাইল (আ.) নিয়মিত আসতে শুরু করেন, তখন তাঁর দানশীলতা বহুগুণ বেড়ে যেত। জিবরাইল (আ.) রমজানের প্রতি রজনীতে নবীজির (সা.) সঙ্গে সাক্ষাতে এসে তার সঙ্গে কোরআন পাঠের অনুশীলন করতেন। নিঃসন্দেহে নবীজি(সা.) ছিলেন বেগবান ঝড়ের চেয়েও অধিক গতির দানশীল। (মুসলিম, হাদিস: ২,৩০৮)
হাদিসের ব্যাখ্যায় ইবনে মুনাইয়ির (রহ.) বলেন, ‘দরিদ্র, অভাবগ্রস্ত ও ধনী—সকলের কাছেই পৌঁছে যেত রাসুলের দানের কল্যাণ। মুক্ত শীতল বায়ুর পর যেমন বৃষ্টির ঝাপটা আসে, রাসুলের (সা.) দান হতো তার চেয়েও ব্যাপক। অন্যান্য মাসের তুলনায় রমজানে তার দানের আধিক্যের কারণ হলো কোরআন পাঠ তার আত্মার প্রাচুর্য বাড়িয়ে তুলত।’ (ফাতহুল বারি, ৪/১৩৯ ও ১/৪১)ইবনে উসাইমিন বলেন, ‘রাসুলের (সা.) দানশীলতা ছিল সর্বব্যাপী। তিনি মানুষের হেদায়েতের জন্য যেমন আল্লাহর সম্পদ ব্যয় করতেন এবং মানুষের সর্বাত্মক প্রয়োজন পূরণ করতে উদ্যত হতেন, তেমনি অজ্ঞ উম্মাহকে শিক্ষাদান করার জন্য সমভাবে ব্যয় করতেন খোদা প্রদত্ত জ্ঞান।’ (মাজমুউ ফাতাওয়া, ২০/২৬২)
তা ছাড়া রাসুল (সা.)এ-মাসের সদকাকে অন্য সকল সদকার তুলনায় মর্যাদা দিয়েছেন। আনাস (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করা হলো কোন সদকা উত্তম। তিনি বলেন, ‘রমজানের সদকা।’ (তিরমিজি, হাদিস: ৬৬৩)
অন্য হাদিসে রমজানকে ‘সহমর্মিতার মাস’ বলা হয়েছে। বলা হয়েছে অপর ব্যক্তিকে ইফতার করানোর বিশেষ সাওয়াবের কথা, ‘যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে, তাকে তার রোজার সমান সওয়াব দেওয়া হবে এবং রোজাদারের সাওয়াবেও কোনো হ্রাস পাবে না।’ (সহিহ ইবনে খুজাইমা, হাদিস: ১,৭৭৮; বাইহাকি, শুয়াবুল ইমান, হাদিস: ৩,৩৩১)
রমজানে দানের ফজিলত অনেক বেশি। তাই অন্য ১১ মাসের তুলনায় এ মাসে অধিক দান-সাদকা করা উচিত। রাসুল (সা.) তার উম্মতদের বাস্তব শিক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে রমজান মাসে বদান্যতার হাত বেশি প্রসারিত করতেন। তা ছাড়া রমজানে প্রতিটি আমলের ফজিলত ৭০ গুণ বেশি হয়। আর ৭০টি নফল একটি ফরজের সমান হয়। আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) থেকে বর্ণিত, রমজান মাসে অন্যান্য মাসের তুলনায় রাসুল (সা.) অনেক বেশি দান করতেন। (নাসায়ি, হাদিস: ৩,০৩০)
ইমাম শাফেয়ি (রহ.) বলেন, রাসুল(সা.) কে অনুসরণ করে লোকজন এ মাসে অধিক হারে দান করবে, এটা খুবই পছন্দনীয় বিষয়। কারণ, অধিকাংশ মানুষ এ সময় নামাজ ও রোজা পালনে ব্যস্ত থাকার ফলে উপার্জনে ঘাটতি দেখা দেয়, তাই এ দান সামগ্রিকভাবে কল্যাণ বয়ে আনে। (বাইহাকি, মারেফাতুন সুনানি ওয়াল আসার (৭/৩০৭)
মহানবীর (সা.) ইতিকাফ
মহানবী (সা.) রমজানে ইতিকাফ পালন করতেন একান্ত কিছুটা সময় আল্লাহর সান্নিধ্যে যাপন করার জন্য। প্রতি বছর রমজানে তিনি মদিনার মসজিদে ইতিকাফ করতেন। তার ইন্তেকালের পর তার স্ত্রীরাও ইতিকাফ করেছেন। (বুখারি, হাদিস: ২,০৪১)
তিনি মৃত্যু-পূর্ব পর্যন্ত রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করেছেন (বুখারি, হাদিস: ২,০২৬)। কেন? তিনি নিজেই জানিয়েছেন, ‘আমি কদরের রাত্রির সন্ধানে প্রথম দশ দিন ইতিকাফ করলাম। এরপর ইতিকাফ করলাম মধ্যবর্তী দশদিনে। পরে ওহির মাধ্যমে আমাকে জানানো হলো যে, তা শেষ দশ দিনে। সুতরাং তোমাদের যে ইতিকাফ করবে, সে যেন (এ-সময়) ইতিকাফ করে। ফলে, লোকজন তার সঙ্গে ইতিকাফ অংশ নিল। (মুসলিম, হাদিস: ১,১৬৭)
তবে আবু হোরাইরা (রা.) জানান যে, যে-বছর তিনি পরলোকগত হন, সে বছর ইতিকাফে কাটিয়েছেন তিনি বিশ দিন (বুখারি, হাদিস: ২,০৪৪)
কোথায় অবস্থান করতেন
ইতিকাফকালে রাসুল (সা.) মসজিদে সবার থেকে আলাদা করে একটি তাঁবু-সদৃশ টানিয়ে দেওয়ার আদেশ দিতেন। আবু সাইদ (রা.) বলেন, ‘নবীজি (সা.) এক তুর্কি তাঁবুতে ইতিকাফে বসলেন, যার প্রবেশমুখে ছিল একটি চাটাইয়ের টুকরো। (একবার) তিনি চাটাইটি হাতে ধরে একপাশে সরিয়ে রাখলেন এবং চেহারা বের করে লোকজনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করলেন। (ইবনে মাজাহ, হাদিস: ১,৭৭৫)
বিশ তারিখের দিবসের সূর্যাস্তের পর একুশ তারিখের রাতের সূচনালগ্নে তিনি ইতেকাফগাহে প্রবেশ করতেন এবং বের হতেন ঈদের চাঁদ দেখা যাওয়ার পর। আয়েশা (রা.) জানান যে, নবীজি (সা.) ফজর আদায় করে ইতেকাফগাহে প্রবেশ করতেন। (মুসলিম, হাদিস: ১,১৭৩)
ইতিকাফের সময় কী করতেন
ইতিকাফকালে তিনি কোনো অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যেতেন না, জানাজায় অংশ নিতেন না, স্ত্রী-সঙ্গ ত্যাগ করতেন। তবে স্ত্রীরা তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন এবং কথা বলতেন। সাফিয়া (রা.) বলেন, নবীজি (সা.) ইতিকাফে ছিলেন, আমি তার সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য এলাম, আলাপ করলাম, এরপর চলে এলাম...। অন্য বর্ণনায় আছে, নবীজি (সা.)তাঁকে পৌঁছে দিতে এগিয়ে গেলেন। অথচ নবীজি(সা.)ইতিকাফে ছিলেন এবং সাফিয়ার আবাস ছিল উসামা বিন জায়েদের বাড়িতে। যদিও তিনি অত্যাবশ্যকীয় কোনো কারণ ব্যতীত ইতেকাফগাহ হতে বের হতেন না। (বুখারি, হাদিস: ৩,২৮১, ৩,০৩৯, ২,০২৯)
ইতিকাফের অজুহাতে যারা পরিবারের কথা ভুলে যায়, তারা এ থেকে শিক্ষা নিতে পারেন। এমনকি স্ত্রীকে ঘর পর্যন্ত এগিয়ে দিতে তিনি বাইরেও বেরিয়েছেন। কোনো বর্ণনায় আছে, আয়েশা (রা.) তাঁর মাথার চুল গুছিয়ে দিতেন (বুখারি, হাদিস: ২৯৬)। একবার তিনি মসজিদে অবস্থান করছিলেন, স্ত্রীরা তার পাশে ছিলেন এবং তারা ছিলেন আনন্দিত...। (বুখারি, হাদিস: ১,৮৯৭)
ইতিকাফের কাজা আদায়
আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) ইতিকাফ করবেন বলে মনস্থ করলেন, ফজরের নামাজ আদায় করে ইতেকাফগাহে প্রবেশ করলেন। জয়নব (রা.) চাইলেন তার সঙ্গে ইতিকাফ করবেন। তিনি অনুমতি দিলেন। তার জন্যও তাঁবু টানানো হলো। এরপর রাসুলের অন্য স্ত্রীরাও একে একে এসে তাঁবু টানালেন এবং ইতিকাফ করবেন বলে আগ্রহ প্রকাশ করলেন। ফজর নামাজ শেষে রাসুল (সা.) অনেকগুলো তাঁবু দেখে বললেন, তোমরা কি এর মাধ্যমে পুণ্য অর্জন করতে চাইছ? এরপর তিনি নির্দেশ দিলেন তার তাঁবু সরিয়ে নিতে এবং তিনি রমজানে ইতিকাফ পরিত্যাগ করলেন। সে-বছর শাওয়ালের প্রথম দশদিন সেই ইতেকাফের কাজা আদায় করেছেন তিনি। (সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস: ৩৬৬৩)
আরেকবার সফরে থাকার কারণে ইতিকাফ পালন সম্ভব না হওয়ায় তিনি রাসুল(সা.) পরবর্তী বছর বিশ দিন ইতিকাফ করে তা কাজা করে নেন। (তিরমিজি, হাদিস: ৮০৩)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন