সাহাবিরা যেভাবে মহানবী (সা.)-কে মানতেন

 


নবীজি(সা.) র আনুগত্য প্রদর্শনে সাহাবিগণ অনন্য সব দৃষ্টান্ত পেশ করেছেন। প্রথমত তাঁর আনুগত্য মানে আল্লাহর আদেশ পালন। দ্বিতীয়ত তাদের অন্তরে নবীজির প্রতি যে ভালোবাসা ছিল, সেই ভালোবাসার আহ্বানে তারা সাড়া দিয়েছেন। মানুষ তার সহজে মানে, যাকে সে ভালোবাসে। আমরা মাত্র তিনটি উদাহরণ উপস্থাপন করছি।

১. জুমার দিন মসজিদের মিম্বরে উঠে নবীজি (সা.) বললেন, ‘বসো তোমরা।’ আবদুলাহ ইবনে মাসউদ (রা.) শোনামাত্র মসজিদের দরজায় বসে গেলেন। তিনি ‘বসো’ শব্দটি শুনে নিজেকে আর এক পা এগোনোর অনুমতি দেননি; যেখানে ছিলেন, সেখানেই বসে গেলেন। নবীজি তাকে দেখলেন যে, তিনি দরজার মুখে বসে গেছেন। বললেন, ‘আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ, এগিয়ে এসো।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ১,০৯১)

২. আবু আবদুর রহমান ফাহরি (রা.) বলেন, নবীজির (সা.) সঙ্গে আমি হোনাইনের যুদ্ধে উপস্থিত ছিলাম। গ্রীষ্মের দিনে আমরা প্রচণ্ড রোদের মধ্য দিয়ে চলছিলাম। একসময় সকলে গাছের ছায়ায় বসলাম। সূর্য হেলে পড়লে আমার বর্মটি পরলাম এবং ঘোড়ায় চড়ে নবীজির কাছে এলাম। তিনি তার তাঁবুতে ছিলেন। তাকে সালাম দিয়ে বললাম, আল্লাহর রাসুল, ‘আমাদের যাওয়ার সময় হয়েছে কি?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ।’ এরপর তিনি ‘বেলাল’ বলে ডাক দিলেন। বেলাল (রা.) সামুরা গাছের নীচ থেকে ছুটে এলেন। তার ছায়া দেখে মনে হচ্ছিল যেন পাখির ছায়া। তিনি বললেন, ‘আমি হাজির।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ৫,২৩৩)

পাখির ছায়া’ বলার কারণ হলো, নবীজির আওয়াজ শোনামাত্র বেলাল (রা.) এত দ্রুত এসেছেন, যেন তার দু’পা মাটিতে ছিল না, ছায়া দেখে মনে হচ্ছিল পাখির ছায়া।

৩. উসাইদ ইবনে জহির (রা.) বলেন, রাফে ইবনে খাদিজ (রা.) আমাদের কাছে এসে বললেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) তোমাদের একটি বিষয় নিষেধ করেছেন, যা তোমাদের জন্য উপকারী। তবে মনে রেখো, আল্লাহ ও তার রাসুলের আনুগত্য করা আরও বেশি উপকারী। (সুনানে নাসায়ি, হাদিস: ৩,৮৯৭)

অর্থাৎ, আল্লাহর রাসুল যা বলেছেন, তাতে বাহ্যিক দৃষ্টিতে উপকারী বিষয় গ্রহণে নিষেধ করেছেন বোঝা গেলেও তাতে দ্বিধায় পড়েননি সাহাবিরা। বরং বুঝে নিয়েছেন যে, নিশ্চয় রাসুলের কথা মেনে নিলে আল্লাহ এর চেয়ে বেশি উপকার দেবেন।

মহানবীর (সা.) জীবনচরিত পাঠ করলে সাহাবিদের নবীপ্রেমের এমন সব উপমা পাওয়া, যা আমাদের বিস্ময়ে হতবাক করে দেয়। আমরা মাত্র ৫টি ঘটনা উল্লেখ করছি।

১. ষষ্ঠ হিজরিতে হোদায়বিয়া নামক স্থানে মক্কার কুরাইশদের সঙ্গে মদিনার মুসলমানদের সন্ধি চুক্তি সম্পন্ন হয়। চুক্তির আগে কুরাইশের প্রতিনিধি হিসেবে পাঠানো হয় উরওয়া ইবনে মাসউদকে। তিনি তখনো মুসলিম হননি। তিনি মুসলিম প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপের ফাঁকে মহানবীর (সা.) প্রতি সাহাবিদের আনুগত্য সম্পর্ক ধারণা লাভ করেন। চুক্তির পর কুরাইশের কাছে ফিরে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি বহু রাজা-বাদশার কাছে প্রতিনিধি হিসেবে গিয়েছি, এমনকি কায়সার-কিসরা-নাজ্জাশির সামনেও রাজদূত হিসেব উপস্থিত হয়েছি, কিন্তু আল্লাহর শপথ, কোনো বাদশাকে তার সহচরদের থেকে এতটা সম্মান পেতে দেখিনি, যতোটা সম্মান মুহাম্মাদকে তার সঙ্গীরা করছে। ‘ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ২,৭৩২)

২. খ্যাতিমান সাহাবি আমর ইবনে আ’স (রা.) বলেন, ‘নবীজির (সা.) চেয়ে বেশি প্রিয় আমার কাছে আর কেউ নেই এবং আমার দৃষ্টিতে তার চেয়ে সম্মানীও কেউ নেই। তার দিকে কখনো আমি পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাতে পারিনি। যদি আমাকে তার দেহাবয়ব বর্ণনা করতে বলা হয়, তাহলে আমি তা পারব না। কারণ, তার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকানো আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১২১)৩. উহুদ যুদ্ধ শেষ হলে নবীজি (সা.) বললেন, ‘কে আমার কাছে সা’দ ইবনে রবির খবর নিয়ে আসবে?’ এক সাহাবি বললেন, ‘আমি আনছি, আল্লাহর রাসুল (সা.) ।’ খুঁজতে খুঁজতে এক জায়গায় এসে তিনি দেখলেন, সা’দ ইবনে রাবি আহত অবস্থায় ময়দানে পড়ে আছেন। তার শেষ সময় ঘনিয়ে এসেছে। ওই সাহাবি বলেন, ‘আমি তাকে বললাম, নবীজি (সা.) আপনাকে খুঁজে দেখতে বলেছেন যে, আপনি জীবিত আছেন, নাকি মৃতদের দলে চলে গেছেন।’ সা’দ বললেন, ‘আমি মৃতদের দলে। তুমি আমার পক্ষ থেকে নবীজির (সা.) কাছে সালাম পৌঁছে দেবে এবং তাকে বলবে, সা’দ ইবনে রবি আপনাকে বলেছে, আমাদের পক্ষ থেকে আল্লাহ আপনাকে তেমন উত্তম প্রতিদান দিন, যেমন প্রতিদান কোনো নবীকে তার উম্মতের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়। আর তোমার গোত্রকেও আমার পক্ষ থেকে সালাম দেবে এবং তাদের বলবে, সা’দ ইবনে রাবি তোমাদের বলেছে, আল্লাহর কাছে তোমাদের কোনো অজুহাত থাকবে না, যদি তোমাদের দৃষ্টি অক্ষত অবস্থায় নবীজির (সা.)  ওপর সামান্য আঘাত আসে।’ সাহাবি বলেন, ‘তারপর আমি তাকে ছেড়ে আসতে না আসতেই তার প্রাণ চলে গেল।’ (সিরাতে ইবনে হিশাম, ২/৯৪)

৪. বদর যুদ্ধের পূর্বক্ষণে নবীজি (সা.) মুসলমানদের সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করাচ্ছিলেন। তাঁর হাতে একটি তির ছিল। সাওয়াদ ইবনে গাজিয়ার কাছে পৌঁছে তিনি দেখলেন, সে কাতারের বাইরে। নবীজি (সা.) (তাকে তীরের খোঁচা দিয়ে) বললেন, ‘সাওয়াদ, সোজা হও।’ সাওয়াদ বলল, ‘আপনি আমাকে কষ্ট দিয়েছেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) । আমিও আপনার মতো করব।’ নবীজি (সা.) তাকে তীরটি দিলেন এবং তার পেটের ওপর থেকে কাপড় সরালেন। সাওয়াদ নবীজি(সা.) কে জড়িয়ে ধরলেন এবং চুমু খেলেন। নবীজি তাকে বলেন, ‘তুমি কেন এমন করলে?’ সে বলল, ‘আল্লাহর রাসুল, একটু পর যুদ্ধ শুরু হবে। আমি চেয়েছি, শেষ সময়ে আমার চামড়া আপনার চামড়াকে স্পর্শ করুক।’ নবীজি (সা.) তার জন্য কল্যাণের প্রার্থনা করলেন। (সিরাতে ইবনে হিশাম, ১/৬২৬)

৫. নবীজির (সা.) জীবনীগ্রন্থগুলোতে ‘ইয়াওমুর রাজি’ নামক একটি বিশ্বাসঘাতকতার ঘটনা জানা যায়। সে-সময় ধোঁকা দিয়ে জায়েদ ইবনে দাসিনা ও খোবাইব ইবনে আদিকে নামের দুই সাহাবিকে অবিশ্বাসী কুরাইশের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়। কুরাইশরা তাদের দুজনের জন্য মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে। জায়েদ ইবনে দাসিনাকে হত্যার জন্য হাজির করা হলে কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান তাকে বললেন, ‘জায়েদ, তুমি কি চাও যে, তোমার বদলে মুহাম্মদ এখন আমাদের কাছে থাকবে, তার শিরচ্ছেদ করা হবে, আর তুমি থাকবে তোমার স্ত্রী-পরিজনের মধ্যে?’ তিনি বললেন, ‘খোদার শপথ, আমি এটা কখনো চাই না যে, আল্লাহর রাসুল (সা.)  যেখানে আছেন, সেখানেই একটি ছোট কাঁটা বিঁধে তিনি কষ্ট পাবেন আর আমি আমার পরিবার নিয়ে থাকি।’ আবু সুফিয়ান বললেন, ‘মুহাম্মদকে তার সঙ্গীরা যেমন ভালোবাসে, মানুষের প্রতি মানুষের এমন ভালোবাসা আমি আর দেখিনি।’ (সিরাতে ইবনে হিশাম, ২/১৭২)

এ ছাড়া হোদায়বিয়ার ঘটনার পরের বছর যখন নবীজি (সা.) ওমরাহ কাজা করতে ইহরাম বেঁধে হারাম শরিফে প্রবেশ করেন, সে-সময় সাহাবিগণ তাঁকে এমনভাবে ঘিরে রেখেছিলেন যেমন নারীদের চুড়ি হাতের কবজিকে ঘিরে রাখে। তারা মক্কাবাসী থেকে নবীজিকে (সা.) আড়ালে রাখতে চেয়েছিলেন, যেন কেউ দূর থেকে তীর নিক্ষেপ করে তাকে আহত করতে না পারে, বরং তেমন হলে যেন অন্য কেউ আহত হয়। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১,৭৯১)

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সহজ দশটি(১০)টি জিকির!

দিরিলিসের আরতুগ্রুলের সকল পর্ব কিভাবে দেখবেন?

❝সূরা হুজুরাত❞