মা-বাবার সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করার কয়েকটি আয়াত ও হাদিস
আধুনিক জীবনের দ্রুতগতি ও বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে আমরা প্রায়ই ভুলে যাই মা-বাবার ত্যাগ, ভালোবাসা ও অকৃত্রিম যত্নের মূল্য। তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা ও দায়িত্ব পালন কখনো কখনো কিছু উপহার বা বিশেষ দিনে শুভেচ্ছা কার্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে।
কিন্তু ইসলাম মা-বাবার প্রতি কর্তব্যকে এমন একটি পবিত্র দায়িত্ব হিসেবে বিবেচনা করে, যা তাঁদের জীবদ্দশায় এবং মৃত্যুর পরও অব্যাহত থাকে। তাঁদের প্রতি কর্তব্য পালন ইসলামের একটি মৌলিক শিক্ষা।
আমরা কয়েকটি আয়াত ও হাদিস তুলে ধরব, যা মা-বাবার সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করতে প্রেরণা জোগাবে।
মা-বাবার প্রতি সদ্ব্যবহারকে ইমানের ঠিক পরই স্থান দেওয়া হয়েছে। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে আল্লাহর ইবাদতের পাশাপাশি মা-বাবার প্রতি দায়িত্ব পালনও একটি অপরিহার্য ইবাদত।
১. ইমানের পরই মা-বাবার প্রতি দায়িত্ব
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘তোমার রব নির্দেশ দিয়েছেন যে তোমরা তাঁকে ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করবে না এবং মা-বাবার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে।’ (সুরা ইসরা, আয়াত: ২৩)
এই আয়াতে মা-বাবার প্রতি সদ্ব্যবহারকে ইমানের ঠিক পরই স্থান দেওয়া হয়েছে। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে আল্লাহর ইবাদতের পাশাপাশি মা-বাবার প্রতি দায়িত্ব পালনও একটি অপরিহার্য ইবাদত।
২. ‘কখনো বিরূপ আচরণ কোরো না’
আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমার মা-বাবা যদি তোমার সঙ্গে থাকাকালে বৃদ্ধ বয়সে পৌঁছান, তবে তাঁদের প্রতি “উফ” পর্যন্ত বোলো না এবং তাঁদের ধমক দিয়ো না; বরং তাঁদের সঙ্গে সম্মানজনক ও ভদ্রভাবে কথা বলো।’ (সুরা ইসরা, আয়াত: ২৩)
তোমার মা-বাবা যদি তোমার সঙ্গে থাকাকালে বৃদ্ধ বয়সে পৌঁছান, তবে তাঁদের প্রতি ‘উফ’ পর্যন্ত বোলো না এবং তাঁদের ধমক দিয়ো না।
মা-বাবার প্রতি সামান্যতম অসম্মানজনক আচরণও নিষিদ্ধ। এমনকি তাঁদের বার্ধক্যজনিত দুর্বলতার সময়ও আমাদের ধৈর্য ও শ্রদ্ধা বজায় রাখতে হবে।
৩. ‘তাঁদের ত্যাগ ও অনুগ্রহ স্মরণ করো’
আল্লাহ বলেছেন, ‘তাঁদের প্রতি দয়া ও নম্রতার সঙ্গে নিজেকে নত করো এবং বলো, “হে আমার প্রতিপালক, তাঁদের প্রতি রহম করুন, যেমন তাঁরা আমাকে ছোটবেলায় লালন-পালন করেছেন।”’ (সুরা ইসরা, আয়াত: ২৪)
মা-বাবা আমাদের শৈশবে যে অক্লান্ত ত্যাগ ও ভালোবাসা দিয়েছেন, তা কখনো ভোলা উচিত নয়। তাঁদের জন্য দোয়া করা এবং তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা আমাদের কর্তব্য।
৪. অমুসলিম মা-বাবার প্রতিও সদয় আচরণ
আল্লাহ বলেছেন, ‘যদি তাঁরা (মা-বাবা) তোমাকে আমার সঙ্গে এমন কিছুর শরিক করতে বাধ্য করেন, যার সম্পর্কে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, তবে তাঁদের আনুগত্য কোরো না; তবে এই দুনিয়ায় তাঁদের সঙ্গে উপযুক্ত সদয় আচরণ করো।’ (সুরা লুকমান, আয়াত: ১৫)
অর্থাৎ মা-বাবা অমুসলিম হলেও তাঁদের প্রতি সদয় ও ন্যায়সংগত আচরণ করা আমাদের দায়িত্ব। ইমানের ব্যাপারে তাঁদের কথা না শুনলেও তাঁদের সঙ্গে মানবিক ও সম্মানজনক সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে।
মা-বাবা অমুসলিম হলেও তাঁদের প্রতি সদয় ও ন্যায়সংগত আচরণ করা আমাদের দায়িত্ব। ইমানের ব্যাপারে তাঁদের কথা না শুনলেও তাঁদের সঙ্গে মানবিক ও সম্মানজনক সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে।
৫. মায়ের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব
এক ব্যক্তি রাসুল (সা.)-এর কাছে জানতে চাইলেন, ‘আল্লাহর রাসুল, আমার সদয় আচরণ ও যত্নের ব্যাপারে কার অধিকার সবচেয়ে বেশি?’ রাসুল (সা.) উত্তর দিলেন, ‘তোমার মা।’ তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘তারপর কে?’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘তোমার মা।’ তিনি তৃতীয়বার জিজ্ঞেস করলেন, ‘তারপর কে?’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘তোমার মা।’ চতুর্থবার জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, ‘তোমার বাবা।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২,৫৪৮)।
এই হাদিসে মায়ের প্রতি তিন গুণ বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে; যাতে বোঝা যায়, মায়ের মর্যাদা অন্য সবার চেয়ে বেশি এবং তাঁর যত্নের ব্যাপারেও অধিক গুরুত্ব দিতে হবে।
৬. মা-বাবার সেবা জিহাদের সমতুল্য
এক ব্যক্তি রাসুল (সা.)-এর কাছে জিহাদে যাওয়ার অনুমতি চাইলেন। রাসুল (সা.) জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার মা-বাবা কি জীবিত?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ।’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘তাহলে তাঁদের সেবা ও যত্নের মাধ্যমে জিহাদ করো।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২,৫৪৯)
বোঝা যায় যে জিহাদ যখন ফরজের পর্যায় পৌঁছায় না, তখন মা-বাবার সেবা জিহাদের মতো মর্যাদাপূর্ণ ইবাদত হয়ে ওঠে।
৭. মৃত্যুর পরও কর্তব্য
রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যখন একজন মানুষ মারা যায়, তখন তার আমল বন্ধ হয়ে যায়, তিনটি বিষয় ছাড়া: চলমান সদকা (সদকায়ে জারিয়া), উপকারী জ্ঞান এবং সৎ সন্তান, যে তার জন্য দোয়া করে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১,৬৩১)
অর্থাৎ মা-বাবার মৃত্যুর পরও তাঁদের জন্য দোয়া করা এবং তাঁদের নামে সদকা দেওয়ার মাধ্যমে সন্তানকে তাঁদের প্রতি কর্তব্য পালন করে যেতে হবে।
যে ব্যক্তির মা-বাবা, একজন বা উভয়ে, তার জীবদ্দশায় বৃদ্ধ বয়সে পৌঁছান, কিন্তু সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারে না।সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২,৫৫১
৮. তাঁদের অবহেলা জান্নাতবঞ্চিত করে
রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘সে ধ্বংসপ্রাপ্ত, সে ধ্বংসপ্রাপ্ত, সে ধ্বংসপ্রাপ্ত।’ কেউ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কে, হে আল্লাহর রাসুল?’ তিনি বললেন, ‘যে ব্যক্তির মা-বাবা, একজন বা উভয়ে, তার জীবদ্দশায় বৃদ্ধ বয়সে পৌঁছান, কিন্তু সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারে না।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২,৫৫১)
এর মানে হলো মা-বাবার প্রতি অবহেলা আমাদের জান্নাত থেকে বঞ্চিত করতে পারে।
৯. মা-বাবার অবাধ্যতা গুরুতর পাপ
রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আমি কি তোমাদের বলব বড় পাপগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর কোনটি?’ সাহাবিরা বললেন, ‘হ্যাঁ, আল্লাহর রাসুল।’ তিনি বললেন, ‘আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করা এবং মা-বাবার অবাধ্যতা করা।’ (সহিহ বুখারী, হাদিস: ২,৬৫৪)
অর্থাৎ মা-বাবার অবাধ্যতা এমন মহাপাপ, যাকে শিরকের পরই সবচেয়ে বড় পাপ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
ওপরে বর্ণিত কোরআনের আয়াত আর হাদিসগুলো আমাদের শেখায় যে মা-বাবার সঙ্গে সদয় আচরণ, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা, তাঁদের জন্য দোয়া এবং তাঁদের মৃত্যুর পরও তাঁদের জন্য কল্যাণকর কাজ করা আমাদের দায়িত্ব। এই শিক্ষাগুলো আমাদের জীবনে প্রয়োগ করে আমরা তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারি এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারি।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন