হযরত ওমরের মৃত্যু এবং নামাজের গুরুত্ব

 হযরত ওমরের মৃত্যু এবং নামাজের গুরুত্ব

--------------- * -------------------

আমাদের রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন, "তোমাদের মাঝে কেউ যদি মদিনাতে মারা যেতে পারে সে যেন মদিনাতে মারা যায়। কারণ, আমি শেষ বিচারের দিন তার জন্য সুপারিশ করবো।" তাই, হযরত ওমর (রা) আল্লাহর কাছে দোয়া করতেন- "ও আল্লাহ! আমাকে শহীদি মৃত্যু দান করুন এবং ও আল্লাহ! আমাকে রাসূলুল্লাহর শহর মদিনাতে মৃত্যু দান করুন।" এ দোয়া শুনে তাঁর ছেলে আব্দুল্লাহ (রা) বলেন- ইয়া আবাতা! ও আমার প্রিয় বাবা! এ দুইটি দোয়া কীভাবে একসাথে ঘটবে? অর্থাৎ, সে সময় যদি শহীদি মৃত্যু চাইতেন আপনাকে কোথায় যেতে হতো? যুদ্ধের ময়দানে। যে যুদ্ধগুলো সংঘটিত হচ্ছিল রোমান এবং পারস্য সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে মদিনা থেকে শত শত মাইল দূরে। তৎকালীন মদিনা ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ শহর। তাই, আব্দুল্লাহ (রা) বুঝতে পারছিলেন না যে এ দুইটি দোয়া কীভাবে একত্রে বাস্তবায়িত হবে। কীভাবে তিনি মদিনাতে শহিদ হবেন। উত্তরে হযরত ওমর বলেন- "আল্লাহ যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন।" সবকিছুই সম্ভব। মুগিরা ইবনে শু'বা (রা) এর দাস আবু লু'লু আল-মাজুসি হযরত ওমর (রা) কে হত্যা করেন। কারো কারো মতে তার নাম ছিল ফাইরুজ বা ফিরোজ। আমরা তার সম্পর্কে খুবই অল্প জানি। তার সম্পর্কে যা জানা যায় তা হলো- সে নতুন বিজিত অঞ্চল পারস্য থেকে মদিনায় আগমন করে। সে ছিল তৎকালীন ইরানীয় জরাথুস্ট্র ধর্মের অনুসারী। হযরত ওমরের নিয়ম ছিল নতুন বিজিত অঞ্চলের কেউ মদিনায় বাস করতে পারবে না। তবে, অনেক সময় কোনো মুসলিম কারো জন্য অনুমতি চাইলে খলিফা অস্থায়ীভাবে তা প্রদান করতেন। সে রকম একটি ব্যতিক্রম ছিল আবু লু'লু আল-মাজুসি। মুগিরা (রা) হযরত ওমরের কাছে এসে বলেন, আবু লু'লু একজন দক্ষ মিস্ত্রি। আমি তাকে মদিনায় রাখতে চাই। খলিফা তখন অনুমতি প্রদান করেন। যাইহোক, আবু লু'লু খলিফাকে হত্যা করার দুরভিসন্ধি করে। সম্ভবত ওমর (রা) যেহেতু তার দেশ পারস্য জয়লাভ করেছেন তাই সে প্রতিশোধ নিতে এ হত্যাকাণ্ড চালায়। তো, সে ফজরের নামাজের সময় আক্রমণ চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। কেন ফজর? সম্ভবত ভোরের আবছা অন্ধকারে তার জন্য এ কাজ করতে সুবিধা হবে ভেবে। সে তার ছুরিতে বিষ প্রয়োগ করে নেয়। যেন সামান্য আঘাতেই মৃত্যু হয়। তো, একদিন ফজরের সময় সে বিষ মিশ্রিত ছুরিটি নিয়ে মসজিদের ভেতর লুকিয়ে থাকে। খলিফা ওমর যখন দ্বিতীয় রাকাত শেষ করে মাত্র রুকুতে যাবেন... বর্ণনা করা হয়েছে যে, তিনি দ্বিতীয় রাকাতে সূরা আহযাবের কিছু আয়াত তিলাওয়াত করেন। তিনি সর্বশেষ এ আয়াতটি তিলাওয়াত করেন- وَ کَانَ اَمۡرُ اللّٰهِ قَدَرًا مَّقۡدُوۡرَۨا- আর আল্লাহর বিধান সুনির্ধারিত, অবশ্যম্ভাবী। (৩৩:৩৮) অর্থাৎ, আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন তা অবশ্যই ঘটবে। এ আয়াত তিলাওয়াত করে রুকুতে যাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে আবু লু'লু অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে হযরত ওমরকে আক্রমণ করে বসে। একটি ছুরির আঘাত সামনের দিকে, একটি পেছন দিকে এবং একটি আঘাত তলপেটে। তলপেটের আঘাতটিই ছিল প্রাণনাশক আঘাত। হজরত ওমর তখন চিৎকার করে বলে উঠেন, অগ্নিপূজক আমাকে আক্রমণ করেছে। অন্য ভার্সনে এসেছে, তিনি বলে উঠেন, কুকুরটা আমাকে আক্রমণ করেছে। সবাই কিছু বুঝে উঠার আগেই আবু লু'লু সাথে সাথে মসজিদ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। যাওয়ার সময় সে এলোপাতাড়ি সবাইকে ছুরিকাঘাত করতে থাকে। ছুরিতে বিষ থাকায় তার ছুরিকাঘাতে আরো সাতজন মুসলিমের মৃত্যু হয়। শেষ পর্যন্ত সে মসজিদ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পূর্ব মুহূর্তে সাহাবীদের ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়ে যায়। একজন সাহাবী তার জামা খুলে আবু লু'লুর চেহারায় নিক্ষেপ করেন। ফলে চোখ মুখ ঢাকা পড়ে যায় এবং সে কিছুই দেখতে পারছিলো না। তখন অন্যান্য সাহাবারা তাকে ধরাশায়ী করে ফেলেন। আবু লু'লু যখন বুঝতে পারলো যে তার পক্ষে পালিয়ে যাওয়া সম্ভ নয়, তখন সে তার নিজের ছুরি দিয়ে নিজের বুকে আঘাত করে। এতে তার মৃত্যু হয়। তো, সে আত্মহত্যা করে। এদিকে লোকজন ওমর (রা)কে আহত অবস্থায় তুলে তাঁর ছেলে আব্দুল্লাহর বাড়িতে নিয়ে যায়। সম্ভবত, ওমরের নিজের বাড়ির চেয়ে আব্দুল্লাহর বাড়ি মসজিদের নিকটে ছিল, এই কারণে। অন্যান্য সাহাবারা তাড়াতাড়ি নামাজ শেষ করলেন। এতে প্রমাণিত হয়, পরিস্থিতি যাই হোক, পরিস্থিতি থেমে গেলে নামাজ শেষ করে নিতে হবে। ওমর (রা) বেহুঁশ হয়ে পড়েন। তাঁর ছেলে আব্দুল্লাহ 'ইয়া আবাতা' 'ইয়া আবাতা' বলে কাঁদছিলেন। সূর্য উঠে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে ওমরের হুঁশ ফিরে আসে। হুঁশ ফিরে আসার পরে তিনি দেখলেন চারদিকে থেকে লোকজন তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে এবং তাঁর শরীর রক্তে রঞ্জিত। তখন প্রথম যে প্রশ্নটি তাঁর মুখ থেকে বের হয় তা হলো- মানুষ কি নামাজ শেষ করেছে? উত্তরে তাঁরা বললেন- হ্যাঁ। মানুষ তাদের নামাজ শেষ করেছে। ওমর তখন বলেন- "আলহামদুলিল্লাহ। যে নামাজ পরিত্যাগ করেছে ইসলামে তার কোনো অংশ নেই।" এরপর আব্দুল্লাহকে বললেন- আমার জন্য পানি নিয়ে এসো। আব্দুল্লাহ ভেবেছিলেন তিনি হয়তো পানি পান করবেন। কিন্তু, না, তিনি ওযু করার জন্যে পানি চেয়েছেন। তিনি তো তাঁর ফজরের নামাজ শেষ করতে পারেননি। এটাই তাঁর একমাত্র চিন্তা এখন। দেখুন, এমন পরিস্থিতিতে এ ধরণের চিন্তা শুধু একজন মুত্তাকী, একজন মুমিনের মাথাতেই আসতে পারে। তো, প্রথম যে কাজটি তিনি করলেন তিনি তাঁর ফজরের নামাজ শেষ করলেন। যদিও তাঁর শরীর থেকে রক্ত ঝরছিল। এখান থেকে ইসলামী আইনবিদরা বলেন, ক্ষতস্থান থেকে রক্ত বন্ধ না হলে ঐটা আল্লাহ ক্ষমা করে দিবেন। আপনি এ কারণে নামাজ পড়া বন্ধ করবেন না। ফজরের নামাজ আদায় করার পরে তিনি জিজ্ঞেস করেন- কে আমাকে ছুরিকাঘাত করেছে? তারা বললো- অগ্নিপূজক দাস। তিনি জিজ্ঞেস করলেন- মুগীরা ইবনে শো'বার দাস? তারা বললো- হ্যাঁ। মুগীরার গোলাম। তখন তিনি বললেন- আলহামদুলিল্লাহ। যে আমাকে হত্যা করেছে সে কোনো মুসলিম নয়। (তিনি বুঝতে পেরেছেন যে এ আঘাতে তিনি মারা যাবেন।) মৃত্যুর ঠিক আগ মুহূর্তে তিনি বলেন- "আমি আমার মুখ মাটিতে রাখতে চাই।" তারা তাঁকে উঠালেন না। কিন্তু তিনি বলতেই থাকলেন। শেষে তাঁরা তাঁকে উঠিয়ে মাটিতে রাখেন। তিনি সেজদার মত করে তার মুখ মাটিতে রাখলেন। কারণ আহত অবস্থার কারণে তিনি পুরোপুরি সেজদা করতে পারছিলেন না। যেভাবে পারছিলেন তিনি তার মুখ মাটিতে ঠেকিয়ে বলতে লাগলেন- "আল্লাহ যদি আমাকে মাফ না করেন তাহলে আমার কোনো আশা নেই। আমার জন্য দুঃখ হয় যদি আল্লাহ আমাকে ক্ষমা না করেন।" তিনি কেঁদে কেঁদে বার বার আল্লাহর কাছে মাফ চাইতে থাকলেন। এভাবে তিনি আল্লাহর কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করতে করতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। - ড. ইয়াসির কাদির আলোচনা থেকে

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সহজ দশটি(১০)টি জিকির!

দিরিলিসের আরতুগ্রুলের সকল পর্ব কিভাবে দেখবেন?

নিশ্চয়ই কষ্টের সাথেই স্বস্তি আছে