তারা কি আসলে স্বাধীন নাকি বন্দী?


 যারা যা খুশি তা-ই করে তারা কি আসলে স্বাধীন নাকি বন্দী?

প্রত্যেক ব্যক্তি তার কৃত কর্মগুলোর দ্বারা জিম্মি হয়ে আছে। মানুষ মদ্যপানের কাছে জিম্মি হয়ে আছে। মানুষ যৌন আসক্তি দ্বারা, পর্নোগ্রাফি দ্বারা জিম্মি হয়ে আছে। মানুষ মাদকের কাছে জিম্মি হয়ে আছে। মানুষ সময়ের অপচয় দ্বারা জিম্মি হয়ে আছে। তাদের দোষ যা-ই হোক, তাদের অপরাধ যা-ই হোক, তারা সেটার দ্বারা জিম্মি। তারা এর মধ্যে নিজেদেরকে নিমজ্জিত রেখেছে। একমাত্র কিছু মানুষ আসলে এই আসক্তিগুলো, এই বদভ্যাসগুলো থেকে মুক্ত রয়েছে। আমাদের বলা হয়েছে, ইন্টারনেট ব্রাউজিং-এ তুমি স্বাধীন। ইন্টারনেট ব্রাউজিং-এ তুমি স্বাধীন। সোশ্যাল মিডিয়ায় ঢুকতে তুমি স্বাধীন। কিন্তু যদি আপনি আপনার ফোনটি সরিয়ে রাখেন; যদি আপনি দীর্ঘ সময় সোশ্যাল মিডিয়ায় অভ্যস্ত হন; ধরুন, ১৪, ১৫ বছর বছর বয়সী একজন কিশোর, সে যা কিছু দেখার, দেখছে। আর আপনি যদি ফোনটি কেড়ে নেন, সেই কিশোরের কী ঘটে ? সে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে, তার মেজাজ খারাপ হয়, তার মানসিক যন্ত্রণা শুরু হয়, সব ধরণের অদ্ভুত বিষয় শুরু হয়ে যায়। জানেন কেনো ? কারণ তারা আসলে সেই ডিভাইস দ্বারা বন্দী। তারা আসলে মোটেও স্বাধীন নয়। তারা স্বাধীন নয়। ঠিক যেমন, আমাদের শরীর খাবারের চাহিদা থেকে মুক্ত নয়। তাই আমরা যদি খাবারের অভাবে ভুগি, আমাদের খাবারের পেছনে ছুটতে হয়। আমাদেরকে নির্ভর করতে হয়; যেনো আমরা খাবারের কাছে বন্দী। এই দুনিয়া আসক্তি তৈরি করেছে, আর আমরা বন্দী। মানুষ এই আসক্তিগুলোর দ্বারা বন্দী হয়ে আছে। এমন মানুষও আছে যারা ‘অন্যকে প্রভাবিত’ করার প্রয়োজনে বন্দী। তারা সেই কারাগারেই বাস করে। এটাই তারা অর্জন করতে চায়। এবং তারা এর নিচেই চাপা পড়ে। সারাটা জীবন শুধু অন্যকে প্রভাবিত করতে চায়। অন্য কিছু মানুষ ‘সবার উপরে’ থাকার প্রয়োজনে বন্দী। “আমাকে সবার সম্মান করা উচিত”। তাদের গোটা জীবনটাই, “আমাকে শুধু সম্মানিত হতে হবে”। “কিভাবে আপনি সম্মানিত হতে চান” ? “মানুষ যখন কাছে আসবে, তারা যেন আমার দিকে বাঁকা চোখে না তাকায়। তাদের উচিৎ আগে আমাকে সালাম দেয়া। তাদের এটা করতে হবে, তাদের ওটা করতে হবে। এই, তুমি এটা কেনো করলে না ? তুমি ওটা কেনো করলে না” ? “এটাকেই সম্মান মনে করেন” ? “তুমি আমার সাথে এভাবে কথা বলতে পারো না”। তারা এই প্রয়োজন দ্বারা বন্দী। তারা স্বাধীন নয়। তারা স্বাধীন নয়। কিছু মানুষ অহেতুক ভীতিতে বন্দী হয়ে থাকে। ইউসুফের ভাইয়েরা এটা জানার প্রয়োজনে বন্দী ছিলো যে তারাই অধিক ভালোবাসার পাত্র। কারণ তাদের কাছে ভালোবাসা ছিলো একটা স্কোরকার্ড; তাই না? “বাবা ইউসুফকে বেশি ভালোবাসেন”। তোমরা কীভাবে জানলে যে বাবা ইউসুফকে বেশি ভালোবাসেন ? তোমরা কি তাঁর হৃদয় পরীক্ষা করেছো ? এরকম কোনো মিটার আছে ? ‘স্ট্রিট ফাইটার’ গেমের হেলথ বারের মতো ? কিভাবে তোমরা জানলে তিনি তাঁকে বেশি ভালোবাসেন ? আমাকে বলো। তারা তাকে সরিয়ে দিলো, আর তিনি এখনও তাঁকে বেশি ভালোবাসেন ? তোমরা কিভাবে জানলে যে, তিনি তাকে বেশী ভালোবাসেন ? “কিন্তু আমাকে জানতে হবে। এ ব্যাপারে আমার কিছু একটা করা প্রয়োজন”। তারা তাদের প্রয়োজনে বন্দী। কারো উপর মানসিক নির্ভরতা, রাগ... কিছু মানুষ তাদের রাগের কাছে বন্দী। কিছু মানুষ অনুশোচনায় বন্দী হয়ে থাকে। [كُلُّ نَفْسٍ بِمَا كَسَبَتْ رَهِينَةٌ]। মানুষ কারাগারে বাস করছে। আখিরাতে একটি কারাগার অপেক্ষা করছে। কিন্তু মানুষ এই জীবনে নিজেদের জন্য কারাগার তৈরি করতে অত্যন্ত পারদর্শী। আমরা এতে খুবই পারদর্শী। এবং এই আয়াতটি বলছে, অন্য কেউ আপনাকে কারাগারে রাখেনি। এটা আপনার নিজের তৈরী কারাগার। আর একমাত্র যিনি আপনাকে তা থেকে মুক্ত করতে পারেন, তিনি কে ? আপনি, এবং আপনার কর্ম। সুতরাং, হয় আপনি এমন কাজ করতে পারেন যা আপনাকে আরো কারারুদ্ধ করবে; অথবা আপনি কারাগার থেকে মুক্তির পথ অর্জন করতে পারেন। আপনি যদি এই অর্থে জীবন এবং স্বাধীনতা নিয়ে ভাবেন, নারীদের হিজাব পরিহিত দেখলে মানুষ কেনো এত বিচলিত হয় ? তারা বলে, “সকলেই স্বাধীন। তুমি স্বাধীন নও কেনো ? তুমি নিপীড়িত”। তারা খুবই বিরক্ত। আমার এমন কিছু অমুসলিম নারীর সাথে কথা বলার সুযোগ হয়েছে যারা পর্দা করে না এবং তারা কর্পোরেট জগতে কাজ করে। আমি বললাম, “আপনার কর্মক্ষেত্র নিয়ে কিছু বলুন। সবচেয়ে কঠিন বিষয় কোনটি” ? তারা বলে, “কাজের জন্য তৈরি হওয়া”। কয়েকজন মহিলা আমাকে বলেছে, কাজের জন্য তৈরি হওয়াই সবচেয়ে কঠিন কাজ। আমি বললাম, “কেনো ? কেনো এটা এতো কঠিন ? আপনার দাঁত ব্রাশ করাটা কি খুব কঠিন” ? (দর্শকের হাসি)। “না, আমাকে মেকআপে অনেক বেশি সময় দিতে হয়। নির্দিষ্ট ধরনে পোশাক পরতে হয়”। “নির্দিষ্ট ধরনে পোশাক — বলতে কী বোঝায়” ? সে বললো, “আপনি তো জানেন”। আমি বললাম, “আমি জানি না, আপনি কী বুঝাতে চাইছেন”। সে বললো, “দেখুন, আপনার লুক যদি বিশেষ ধরণের না হয়, আপনি উন্নতি করতে পারবেন না”। তো আমি বললাম, “আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি। আমরা ইসলাম নিয়ে কথা বলছি না। আপনাকে একটা বিষয় জিজ্ঞেস করি। এই সমস্ত প্রত্যাশার কারণে আপনি কী নিজেকে বন্দী মনে করেন” ? সে বললো, “হ্যাঁ, ছেলেরা কতো স্বাধীন। তারা যেমন খুশি পোশাক পরতে পারে এবং সেভাবেই যেখানে খুশি যেতে পারে, কিন্তু আমরা তা পারি না”। “ওয়াও ! আর আপনি সেইসব নারীদের বলছেন বন্দী, যাদেরকে এরকমটা করতে হয় না ? আপনিই তো বন্দী এবং এই কারাগারেই আপনি মারা যাচ্ছেন”। [كُلُّ نَفْسٍ بِمَا كَسَبَتْ رَهِينَةٌ] ! অমুসলিমদের কথা ভুলে যান। অমুসলিমদের বদনাম করে আপনাকে ভালো অনুভব করানোর জন্য আমি এখানে আসিনি। আমি চাই আপনি নিজের ব্যাপারে খারাপ অনুভব করুন। (বক্তা এবং দর্শকের হাসি)। আমরা এইসব অনর্থক মানদণ্ড বানিয়েছি আর তারপর এই মানদণ্ড পূরণ না হবার দুঃখে মরে যাই। ‘একটা বিয়ে কেমন হতে হবে’ — এখন আমরা এই মানদণ্ড তৈরি করেছি। এই মানদণ্ড ইসন্সটাগ্রাম থেকে অবতীর্ণ হয়েছে। (বক্তা এবং দ‌র্শকের মৃদু হাসি)। আর এখন আপনার বিয়ে যদি সেই রকম না হয়, “এটা আমার জীবনের সবচেয়ে খারাপ দিন”। (কান্নার কণ্ঠে)। কেনো ? কেনো ? আমরা নিজেদের জন্য এমন কারাগার বানিয়েছি যার কোনো প্রয়োজনই ছিলো না। আমরা নিজেদেরকে জিম্মি বানিয়েছি। আর সেই কারাগারে নিজেদেরকে রাখার জন্য আমরা যেকোনো কিছু করতে প্রস্তুত। ইসলাম আসলো এবং মুক্তিদান করলো। আপনাকে শুধুমাত্র একজনেরই দাসত্ব করতে হবে, আর তিনি হলেন আল্লাহ। আর হ্যাঁ, আপনার খারাপ কাজের জন্য আপনাকে জিম্মি করে রাখা হয়েছে। আর নিজেকে মুক্ত করার জন্য আপনি ভালো কাজ করতে পারেন। শুধু মানুষ হয়ে উঠুন। আপনার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হওয়া উচিৎ — “আমি কি সঠিক কাজটি করছি” ? আপনার উদ্দেশ্য আর এটা থাকবে না — “আমি কি জনপ্রিয় কোনো কাজ করছি ? আমি কি ফ্যাশনেবল কোনো কাজটি করছি ? আমি কি সবচেয়ে বেশি অর্থ উপার্জনকারী কাজটি করছি ? আমি কি প্রতিযোগিতামূলক কাজটি করছি” ? এই প্রশ্নগুলো অদৃশ্য হতে থাকবে। একমাত্র প্রধান যে প্রশ্ন থেকে যাবে তা হলো, “আমি কি সঠিক কাজটা করছি” ? শুধু এটুকুই। “আমি কি সঠিক জিনিস অর্জন করছি” ? ব্যস, এটুকুই। কী অসাধারণ এক বিশ্বদর্শন ! আর এটাই স্বাধীনতা। আমি সঠিক কাজটি করতে স্বাধীন যখন অন্যেরা সবাই কারাগারে রয়েছে। তারা আমার উপর চাপিয়ে দিতে পারে না। এমনকি সেই মেয়েরা, যাদের বিষয়ে সেদিন কথা হচ্ছিল, এক তরুণী ইন্ফ্লুয়েন্সার নারীদের ব্যাপারে বলেছিলো যারা পর্দা ত্যাগ করেছে, ইত্যাদি ইত্যাদি…। তারা কি অন্যদের চোখ আর মতামতের কারাগারে বন্দী নয় এবং এর দ্বারা প্রভাবিত হয়েই পর্দাহীনতার সিদ্ধান্ত নেয় না ? একমাত্র কারাগার, একমাত্র আত্মসমর্পণ যা আমাদের মেনে নেয়া উচিত তা হলো আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ। আর আমি আপনাদের বলছি, কুরআনের দর্শন সত্যিই অসাধারণ। আমরা নিজেদেরকে আল্লাহর দাস বলে থাকি; তাই না ? আমরা নিজেদেরকে আল্লাহর দাস বলে থাকি। এবং কুরআন বর্ণনা করছে, আপনি কোনো না কোনো কিছুর দাস হবেনই। কিন্তু সিদ্ধান্ত আপনার যে আপনি কিসের দাস হতে চান। আপনি হবেন — ফ্যাশনের দাস, টাকার দাস, মানুষের দাস, সংস্কৃতির দাস, মানদণ্ডের দাস, জনপ্রিয়তার দাস, আপনার অহংকারের দাস, অথবা আল্লাহর দাস। আপনি যদি আল্লাহকে বেছে না নেন, তবে অন্যকিছুর দাসে পরিণত হবেন। কিন্তু যদি আল্লাহকে বেছে নেন, অন্য সকল দাসত্ব থেকে আপনি মুক্তি পাবেন। এটাই স্বাধীনতা। এটা আপনাকে অন্য সব কিছু থেকে মুক্ত করবে। একেই সত্যিকার অর্থেই বলা হয় — শৃঙ্খল ভাঙা। আল্লাহ বলেছেন, বাস্তবতা হলো প্রত্যেক মানুষ শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে আছে। এখানে কেবল একটিই বিষয় আছে। আমরা সকলেই আবদ্ধ। আমরা আসলে স্বাধীন নই। আমাদের করা প্রতিটি কাজই এরকম। কল্পনা করুন আমার উপর হাজারো শিকল রয়েছে। আমার প্রতিটি ভালো কাজ সেই শিকলগুলোর একটি করে ভাঙছে। অথবা আমার প্রতিটি খারাপ কাজ সেই শিকলগুলোর সাথে একটি করে যোগ করছে। আর আমি সেই শিকলগুলো দেখতেও পাই না। তারপর বিচারের দিনে সেই সমস্ত শিকল প্রকাশ পাবে। এটাই [كُلُّ نَفْسٍ بِمَا كَسَبَتْ رَهِينَةٌ]। এটা কেবল তাদের অর্জন, যা তারা করছে, এর জন্যই তারা জিম্মি হয়ে আছে। সুবহানাল্লাহ ! এটি একটি বিস্ময়কর এবং আশ্চর্যজনক বাস্তবতা। এটি একটি অবিশ্বাস্য বাস্তবতা। —নোমান আলী খান

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সহজ দশটি(১০)টি জিকির!

দিরিলিসের আরতুগ্রুলের সকল পর্ব কিভাবে দেখবেন?

নিশ্চয়ই কষ্টের সাথেই স্বস্তি আছে