আল–কোরআনের বিশ্বজনীন সুর

 


ঐশী বাণীর স্রোত যখন মরুর বুকে নেমে এল, তখন তা কেবল একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ড বা গোষ্ঠীর জন্য আসেনি; বরং তা ছিল পুরো মানবজাতির জন্য এক চিরন্তন সংলাপের সূচনা।

ইসলামের মূলপাঠ্য কোরআন কেবল মুসলিম জীবনের পথনির্দেশ বা মুসলিম সমাজ ও রাষ্ট্রের অনুশাসন নয়। এর আবেদন আরও গভীর, আরও ব্যাপক। কোরআনের আহ্বান দল-মত–ধর্ম-বর্ণের প্রাচীর পেরিয়ে প্রতিটি মানুষের জন্যই আপন দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়।

কোরআন এক মহাজাগতিক গ্রন্থ। এর প্রতিটি পাতায় বিশ্বজনীনতার যে সুর অনুরণিত হয়, তা মানবহৃদয়কে স্পর্শ করে। এই গ্রন্থের প্রথম সুরার প্রথম আয়াতেই ঘোষণা করা হয়েছে: ‘সকল প্রশংসা বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য।’ (সুরা ফাতিহা, আয়াত: ১)

এখানে আল্লাহকে কোনো বিশেষ জাতি বা সম্প্রদায়ের প্রভু হিসেবে চিহ্নিত না করে সমগ্র সৃষ্টিজগতের অধিপতি হিসেবে পরিচয় দেওয়া হয়েছে।

একইভাবে কোরআনের শেষ সুরায় এসেও এই সুর অটুট থাকে। তাতে মানুষকে আশ্রয় প্রার্থনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে: ‘বলো, আমি আশ্রয় প্রার্থনা করছি মানুষের প্রতিপালকের, মানুষের অধিপতির, মানুষের উপাস্যের।’ (সুরা নাস, আয়াত: ১-৩)

তাওরাতের বর্ণনার মতো তিনি কেবল বনী ইসরায়েলের প্রভু নন, বরং কোরআনে তিনি ‘রাব্বুল আলামিন’—বিশ্বজগতের প্রতিপালক এবং ‘রাব্বুন্নাস’—সমগ্র মানবজাতির প্রতিপালক। আয়াতটি কোরআনের আহ্বানের বিশ্বজনীন চরিত্রকে সুস্পষ্ট করে তোলে।

কোরআনের পাতায় পাতায় আল্লাহ যখন মানুষকে ডাকেন, তখন তাঁর সেই আহ্বানে কোনো ভৌগোলিক, শ্রেণিগত বা বর্ণগত ছাপ থাকে না। তিনি সরাসরি ‘মানবজাতিকে’ সম্বোধন করেন।

কোরআনের পাতায় পাতায় আল্লাহ যখন মানুষকে ডাকেন, তখন তাঁর সেই আহ্বানে কোনো ভৌগোলিক, শ্রেণিগত বা বর্ণগত ছাপ থাকে না। তিনি সরাসরি ‘মানবজাতিকে’ সম্বোধন করেন। যেমন ‘হে মানবজাতি, তোমরা তোমাদের সেই প্রতিপালকের উপাসনা করো, যিনি তোমাদের এবং তোমাদের পূর্ববর্তীদের সৃষ্টি করেছেন, যেন তোমরা ধর্মভীরু হও।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ২১)

এই আহ্বান আরও স্পষ্ট হয় যখন আল্লাহ মানুষের ভেতরের বিভেদকে অগ্রাহ্য করে তার সৃষ্টির মৌলিক একতার কথা স্মরণ করিয়ে দেন, ‘হে মানুষ! আমি তোমাদের সবাইকে এক পুরুষ ও এক নারী হতে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদের বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা একে অন্যকে চিনতে পারো।’ (সুরা হুজুরাত, আয়াত: ১৩)

কখনো কখনো এই সম্বোধন আরও নিবিড়, আরও গভীর ও মমতাময় হয়ে ওঠে। তখন আল্লাহ মানুষকে পরম স্নেহে ‘হে আমার বান্দা’ (ইয়া ইবাদি) বলে ডাকেন। এই ডাক একদিকে যেমন সৃষ্টির প্রতি স্রষ্টার সম্মান ও মর্যাদার প্রতীক, তেমনই এতে মিশে থাকে এক গভীর আন্তরিকতা ও নৈকট্যের উষ্ণতা।

বিশ্বাসীদের উদ্দেশে তাই তিনি বলেন, ‘হে আমার বান্দারা যারা ইমান এনেছ, নিশ্চয়ই আমার পৃথিবী প্রশস্ত, সুতরাং তোমরা কেবল আমারই ইবাদত করো।’ (সুরা আনকাবুত, আয়াত: ৫৬)

আবার পথভ্রষ্ট, অনুতপ্ত বান্দাকে কাছে টানার জন্যও এই ডাক ধ্বনিত হয় পরম করুণার সুরে: ‘বলো, হে আমার বান্দারা যারা নিজেদের ওপর অবিচার করেছ, তোমরা আল্লাহর করুণা থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব গুনাহ ক্ষমা করে দেন।’ (সুরা যুমার, আয়াত: ৫৩)

কোরআনের এই সংলাপ পূর্ববর্তী আসমানি ধর্মের অনুসারীদেরও ভুলে যায়নি। ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের কোরআন সম্ভাষণ করেছে ‘হে আহলে কিতাব’ বা ‘হে গ্রন্থধারীগণ’ বলে—যা তাদের জ্ঞান ও ঐতিহ্যের প্রতি একধরনের স্বীকৃতি।

কোরআনের এই সংলাপ পূর্ববর্তী আসমানি ধর্মের অনুসারীদেরও ভুলে যায়নি। ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের কোরআন সম্ভাষণ করেছে ‘হে আহলে কিতাব’ বা ‘হে গ্রন্থধারীগণ’ বলে—যা তাদের জ্ঞান ও ঐতিহ্যের প্রতি একধরনের স্বীকৃতি।

তাদের বিবাদের পথে না ডেকে ঐক্যের পথে আহ্বান করে বলা হয়েছে, ‘বলো, হে আহলে কিতাব, এসো এমন একটি কথায়, যা আমাদের ও তোমাদের মধ্যে এক।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ৬৪)

এটি ছিল বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাসের মধ্যে সেতুবন্ধনের এক ঐতিহাসিক প্রয়াস।

পাশাপাশি, যারা এই বাণীতে বিশ্বাস স্থাপন করেছে, সেই মুসলিমদের জন্যও রয়েছে বিশেষ সম্বোধন—‘যারা ইমান এনেছ’। এই ডাকটি মূলত মদিনায় ইসলামি সমাজ একটি স্বতন্ত্র রূপ লাভ করার পর বেশি শোনা যায়, যেখানে বিশ্বাসীদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

এই সব কটি সম্বোধন তৎকালীন পৃথিবীর জন্য ছিল অভূতপূর্ব। আরব উপদ্বীপে মানুষ পরিচিত হতো গোত্র বা বংশের নামে। যেমন, ‘হে কুরাইশ’, ‘হে তাগলিব গোত্রের লোক’। অথবা জাতিগত পরিচয়ে, যেমন, ‘হে আরব’, ‘হে অনারব’। সেখানে বিশ্বাসের বন্ধনে আবদ্ধ করে কিংবা সরাসরি ‘মানবজাতি’ হিসেবে সম্বোধন করার এই রীতি ছিল এক সামাজিক ও আধ্যাত্মিক বিপ্লব।কোরআন প্রথম দিন থেকেই আপন বিশ্বজনীন চরিত্র ঘোষণা করেছে। এই বার্তা কোনো নির্দিষ্ট ভূখণ্ড বা কালের গণ্ডিতে আবদ্ধ নয়; বরং তা মানবজীবনের সব দিককে ঘিরে এক চিরন্তন পথনির্দেশ।

ইসলামের পথে মানুষকে ডাকার পদ্ধতিটিও কোরআন অত্যন্ত স্পষ্টভাবে এঁকে দিয়েছে। সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ নির্দেশনাটি সম্ভবত এই আয়াতে বিবৃত, ‘তোমার প্রতিপালকের পথের দিকে আহ্বান করো হিকমত (প্রজ্ঞা) এবং সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে। আর তাদের সঙ্গে বিতর্ক করো সবচেয়ে উত্তম পন্থায়।’ (সুরা নাহল, আয়াত: ১২৫)

এই নির্দেশ কেবল আল্লাহর নবীর (সা.) জন্য নয়, বরং তাঁর পরে যাঁরা এই সত্যের মশাল বহন করবেন, তাঁদের সবার জন্যই শাশ্বত কর্মপন্থা।

উপরিউক্ত আয়াতে দুটি পথের কথা বলা হয়েছে। ‘হিকমত’ ও ‘মাওয়িযাহ’। হিকমত বা প্রজ্ঞা মানুষের যুক্তিবোধ ও মস্তিষ্কের দরজায় কড়া নাড়ে। আর মাওয়িযাহ বা হৃদয়গ্রাহী উপদেশ মানুষের অনুভূতি ও হৃদয়ের তন্ত্রিতে সুর তোলে।

কিছু মানুষ যুক্তিনির্ভর, তাদের জন্য প্রজ্ঞার পথ। আবার কিছু মানুষ আবেগপ্রবণ, তাদের হৃদয় ছুঁয়ে যায় কোমল উপদেশ। কোরআনের নিজস্ব শৈলীও ঠিক এমনই।

কিছু মানুষ যুক্তিনির্ভর, তাদের জন্য প্রজ্ঞার পথ। আবার কিছু মানুষ আবেগপ্রবণ, তাদের হৃদয় ছুঁয়ে যায় কোমল উপদেশ। কোরআনের নিজস্ব শৈলীও ঠিক এমনই। এটি একাধারে মানুষের বুদ্ধিকে আলোকিত করে এবং হৃদয়কে জয় করে নেয়।

সত্যের দিকে এই আহ্বান অবশ্যই হতে হবে স্বচ্ছ জ্ঞান ও গভীর অন্তর্দৃষ্টির ওপর ভিত্তি করে। আল্লাহ তাই তাঁর রাসুলকে (সা.) বলতে বলেছেন, ‘বলে দাও, এই আমার পথ। আমি ও আমার অনুসারীরা সুস্পষ্ট উপলব্ধির সঙ্গে আল্লাহর দিকে আহ্বান করি।’ (সুরা ইউসুফ, আয়াত: ১০৮)

এ থেকে বোঝা যায়, যাঁরা মুহাম্মদ (সা.)-কে অনুসরণ করবেন, তাঁরা আল্লাহর পথের আহ্বায়ক হবেন। তাঁদের এই আহ্বানের ভিত্তি হবে জ্ঞান। তাঁদের জানতে হবে ইসলামি বিশ্বাস ও দর্শনের (আকিদা) গভীরতা, জীবনের বিধানাবলির (শরিয়ত) সুস্পষ্ট রূপরেখা এবং নৈতিকতার (আখলাক) সর্বোচ্চ আদর্শ। অনুধাবন করতে হবে—স্রষ্টা, জগৎ, মানুষ ও জীবন সম্পর্কে ইসলামের ধারণা কী এবং মানবজাতির সমস্যার সমাধানে ইসলাম কোন পথ দেখায়।

বস্তুত, কোরআনের আহ্বান এক পরিপূর্ণ আহ্বান। এটি মানুষের মন ও মনন উভয়কেই তৃপ্ত করে। এই আহ্বান একাধারে প্রজ্ঞার আলো এবং মমতার পরশ। কোরআন এক চিরন্তন ঝরনাধারা, যা মানুষের অন্তর্গত পিপাসা নিবারণের জন্য আজও বহমান।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

দিরিলিসের আরতুগ্রুলের সকল পর্ব কিভাবে দেখবেন?

নিশ্চয়ই কষ্টের সাথেই স্বস্তি আছে

ড. খন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর বই Pdf Download