মুসলিম সভ্যতায় ঘরবাড়ি নির্মাণ


 মুসলিম সভ্যতার স্থাপত্য শুধু মসজিদ, মাদরাসা বা প্রাসাদের গল্প নয়, সাধারণ মানুষের বাড়িঘরের গল্পও এখানে অনেক। ঘরবাড়ির স্থাপত্য নকশা ছিল তাদের জীবন, সংস্কৃতি আর অর্থনৈতিক অবস্থার প্রতিফলন। মুসলিম শহরগুলোর পুরোনো মহল্লায় হাঁটলে আজও সেই স্থাপত্যের জৌলুশ চোখে পড়ে।

এই লেখায় আমরা সাধারণ ও মধ্যবিত্ত মানুষের বাড়ির নকশা, নির্মাণশৈলী আর তাদের জীবনযাত্রার ছোঁয়া নিয়ে আলোচনা করব। প্রাসাদ বা দুর্গের গল্প এড়িয়ে আমরা সাধারণ মানুষের ঘরের গল্পে প্রবেশ করব—তাদের দরজা থেকে ছাদ, ঘর থেকে সুবিধা এবং আলো ও শীতলতার ব্যবস্থা পর্যন্ত দেখার চেষ্টা করব।

সাধারণ জীবনের স্থাপত্য

ইসলামের প্রথম দিনগুলোতে আরবের বেদুইন অঞ্চলে বাড়ি বলতে ছিল তাঁবু, চামড়ার বিস্তার বা খেজুরপাতার ছাউনি। কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ তোমাদের জন্য তোমাদের ঘরকে শান্তির আশ্রয় করেছেন এবং পশুর চামড়া থেকে ঘর তৈরি করেছেন।’ (সুরা নাহল, আয়াত: ৮০)

মক্কা বা আরবের উত্তরাঞ্চলে বাড়িগুলো ছিল ছোট, সাধারণ। নবীজির (সা.) মদিনার ঘরগুলো ছিল মসজিদের পাশে কয়েকটি কুঠুরি—কিছু ইট দিয়ে, কিছু খেজুরপাতায় তৈরি, দরজায় কাপড়ের পর্দা। এই কুঠুরিগুলোর পর্দা ছিল মাত্র ১৬০ সেমি উঁচু। (ইবনে সা’দ, তাবাকাতুল কুবরা, ১/২১৮, দারু সাদির, বৈরুত, ১৯৬৮)

ইবনে খালদুন বলেন, স্থাপত্য হলো শহুরে জীবনের প্রাচীনতম কারিগরি। এটি মানুষকে আশ্রয় দেয়, তাদের জীবনকে নিরাপত্তার ধরন প্রমাণ করে। (মুকাদ্দিমা, পৃষ্ঠা ২৩৭, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১৯৮৮)

আবু হায়ান তাওহিদি বলেন, নির্মাণের জন্য দরকার মাটি, পাথর, কাঠ; নকশা; কারিগর; এবং উদ্দেশ্য—যেমন বসবাস বা সম্পদ সংরক্ষণ। (আল-বাসায়ির ওয়াজ জাখায়ির, ২/১৫৪, দারু সাদির, বৈরুত, ১৯৮৮)

উপর্যুক্ত দুজনের বক্তব্য থেকে সেই সময়ের ঘর নির্মাণের উপাদান এবং উদ্দেশ্য সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়।

ইবনে খালদুন আরও বলেন, স্থাপত্য জনগোষ্ঠীর রীতি, জলবায়ু ও অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে। নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে বাড়ি হতো বাঁশ বা মাটি দিয়ে, আর মধ্য অঞ্চলে পাথর ও ইটের ব্যবহার হতো। (ইবনে খালদুন, মুকাদ্দিমা, পৃষ্ঠা ২৩৮)

উদাহরণস্বরূপ, কুফা ও বসরায় প্রথমে খেজুরপাতার বাড়ি ছিল। ৬৩৯ খ্রিষ্টাব্দে আগুন লাগার পর হজরত উমর (রা.) ইট ব্যবহারের অনুমতি দেন। (তাবারি, তারিখ, ৪/২১২, দারু তুরাস, কায়রো, ১৯৬৭)

ধনীদের বাড়ি হতো বড়, প্রাসাদের মতো, যেখানে থাকত ঘোড়ার আস্তাবল বা ভূগর্ভস্থ গুদাম। গরিবেরা ছোট ঘরে সন্তুষ্ট থাকত।

কারিগরদের দক্ষতা

নির্মাণে নানা ধরনের কারিগর কাজ করত—কাঠমিস্ত্রি, রাজমিস্ত্রি, চিত্রকর, প্লাস্টারকারী, ধাতুকর্মী আর দিনমজুর। কারিগরদের দক্ষতার রকমফের ছিল। বাগদাদে তাদের একজন প্রধান থাকত, যাকে ‘উস্তাদ’ বা ‘প্রধান প্রকৌশলী’ বলা হতো। (খতিব বাগদাদি, তারিখ বাগদাদ, ১/৩২৫, দারুল গারব, বৈরুত, ২০০১)

মাকরিজি লিখেছেন, নাসিরি যুগে ইবনে সুয়ুফি ছিলেন প্রধান প্রকৌশলী, যিনি কায়রোর জামে মারদিনি মসজিদ তৈরি করেন। (মাকরিজি, খিতাত, ২/৩১৬, দারু সাদির, কায়রো, ১৮৫৩)

কারিগরদের মধ্যে দিনমজুরদের বলা হতো ‘রুজগারি’ (ফারসি শব্দ, অর্থ দৈনিক কাজের শ্রমিক)। তাঁদের কাজ ছিল দেয়াল সমান করা, পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা বা ভারী পাথর তোলার জন্য দড়ির ব্যবহার করা। (ইবনে খালদুন, মুকাদ্দিমা, পৃষ্ঠা ২৪১)

নির্মাণের নকশা ও ব্যয়

বাড়ির নির্মাণে নকশা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। বাড়ির নকশা দ্বিমাত্রিক বা ত্রিমাত্রিকও হতো। খলিফা মনসুর বাগদাদ শহরের নকশা তৈরি করতে ত্রিমাত্রিক মডেল ব্যবহার করেন। তিনি তুলার দড়ি দিয়ে নকশা তৈরি করে আগুন জ্বালিয়ে এর গঠন অনুমান করতেন। (তাবারি, তারিখ, ৭/২৬৫, দারু তুরাস, কায়রো, ১৯৬৭)

নির্মাণ ব্যয় নির্ভর করত মালিকের অর্থনৈতিক সামর্থ্যের ওপর। ধরা যাক, বুয়াইহি সুলতান মুইজ্জুদ্দৌলার বাড়ি নির্মাণের খরচ ছিল ৪০ মিলিয়ন দিরহাম (আজকের হিসাবে প্রায় ৫০ মিলিয়ন ডলার)। (জাহাবি, তারিখুল ইসলাম, ২৬/১৪৫, দারুল কিতাব, বৈরুত, ১৯৮৭)

তবে কায়রোর একটি বাড়ির গড় দাম ছিল ১০০০ দিনার। ৪০ দিনারে সাধারণত বাড়ি ভাড়া পাওয়া যেত। (সাখাভি, আল-জাওয়াহির ওয়াদ দুরার, পৃষ্ঠা ৪৫৬, দারুল কিতাব, কায়রো, ১৯৯২)

বাড়ির বিভাগ ও নকশা

মুসলিম বাড়ির প্রধান প্রবেশপথ ছিল ‘দিহলিজ’। দিহলিজ, যাকে বাংলায় দহলিজ বা দলিজা বলা হয়, এটা ছিল বৈঠকখানা টাইপের বাইরের ঘর, যার সঙ্গে প্রবেশদ্বার এবং বাড়ির প্রাচীর সম্পৃক্ত থাকে এবং যা বাইরের দরজা থেকে অভ্যন্তরীণ উঠানে যাওয়ার প্রবেশপথ হিসেবেও কাজ করে। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, তিনি নবীজির (সা.) আগমন দেখে একবার একটি দিহলিজে লুকিয়েছিলেন। (আবু আওয়ানা, মুস্তাখরাজ, ৪/১২৩, দারু মারিফা, বৈরুত, ১৯৯৮)

দিহলিজে অতিথি আপ্যায়ন বা এমনকি শৌচাগারও থাকত। (তানুখি, নিশওয়ারুল মুহাদারা, ১/২৩৫, দারু সাদির, বৈরুত, ১৯৭১)

দিহলিজ থেকে যাওয়া যেত ‘সাহন’ বা উঠানে, যা ছিল বাড়ির কেন্দ্রীয় অংশ। এর চারপাশে ঘর, কুঠুরি বা ওপরের তলা থাকত। বড় বাড়ির সাহনে তাঁবু খাটানো হতো অতিথিদের জন্য। কখনো কখনো এখানে হালকা কাঠের তৈরি ফাঁদ রাখা হতো চোর ধরার জন্য। (তানুখি, নিশওয়ারুল মুহাদারা, ২/১৮৭, দারু সাদির, বৈরুত, ১৯৭১)

ঘরগুলোর মধ্যে ছিল অতিথি কক্ষ, যেখানে মেহমানদের বসানো হতো, একে বলা হতো ‘মাজলিস’। শোবার ঘরকে বলা হতো ‘মারকাদ’। পড়ুয়াদের বাড়িতে থাকত ‘বাইতুল কুতুব’ (গ্রন্থাগার)। অনেকে পবিত্র অবস্থায় না থাকলে গ্রন্থাগারে প্রবেশ করতেন না। ছাদে থাকত ‘উল্লিয়া’ (পেন্টহাউস), যেখানে সিঁড়ি (মামরাক) দিয়ে উঠতে হতো। (ইবনে আসাকির, তারিখ দিমাশক, ৫৪/১২৩, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১৯৯৫)

মুসলিম বাড়িতে নিরাপত্তার জন্য একাধিক দরজা থাকত। ধনীদের বাড়ির দরজা হতো লোহা বা তামার তৈরি এবং অসাধারণ কারুকাজে সজ্জিত। কখনো গোপন দরজা বা ভূগর্ভস্থ গুপ্তকক্ষও থাকত নিরাপত্তার জন্য। নিরাপত্তা বাড়াতে কোনো কোনো ঘরে ১৪ থেকে ২০টি পর্যন্ত দরজা রাখা হতো। (তানুখি, আল-ফারাজ বা’দাশ শিদ্দা, ৩/১৮৯)

আলো ও পানির ব্যবস্থা

মুসলিম বাড়িঘরে পানির ব্যবস্থা ছিল খুবই উন্নত। ইবনে খালদুন বলেন, শহরে পানি আনা হতো নালা বা কূপের মাধ্যমে। বাড়িতে কূপ বা জলাধার থাকত। মুয়াবিয়া (রা.)-এর বাড়িতে নিজস্ব কূপ ছিল। তবে কারও কারও বাড়িতে প্রয়োজন অনুপাতে ৫টি বা ৭টি কূপও ছিল। (আজরাকি, আখবার মাক্কা, ১/১৬৭)

দামেস্কে কেউ কেউ রান্নাঘরে পানির নালা ব্যবহার করতেন, যেই নালায় পাত্র ভাসিয়ে দিয়ে খাবার পরিবেশনও করা হতো। (ইবনে আরাবি, আহকামুল কুরআন, ৩/৫৬, দারুল কুতুব, কায়রো, ১৯৬৭)

শৌচাগার প্রথমে বাড়ির বাইরে থাকত। আয়েশা (রা.) বলেন, তাঁরা বাড়িতে শৌচাগার রাখতে অস্বস্তি বোধ করতেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১৪৮)

পরে অবশ্য ধনীদের বাড়িতে শৌচাগারে সোনালি ছাদ বা নল দিয়ে গরম-ঠান্ডা পানির ব্যবস্থা করার প্রচলন ঘটে। (তানুখি, নিশওয়ারুল মুহাদারা, ১/২৯৮, দারু সাদির, বৈরুত, ১৯৭১)

আলোর জন্য জানালা, উঠান, মোমবাতি ও লন্ঠন ব্যবহৃত হতো। ইয়াকুত হামাভি বলেন, কায়রোর ‘জুকাকুল কানাদিল’ নামের রাস্তার পাশে বিত্তবানদের বাড়ির দরজায় লন্ঠন থাকত। (ইয়াকুত, মুজামুল বুলদান, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ৩২১, দারু সাদির, বৈরুত, ১৯৯৫)

সৌন্দর্য ও সজ্জা

গরম অঞ্চলে বাড়ি শীতল রাখতে হাতপাখা আর ভিজা কাপড় (খাইশ) ব্যবহৃত হতো। ছাদে গাছ লাগিয়ে বাগান তৈরি করা হতো শীতলতার জন্য। মিসরের কায়রোর অনেক বাড়িঘরের ছাদে গাছ লাগানো হতো। (নাসের খসরু, সফরনামা, পৃষ্ঠা ১৪৫, দারু সাদির, তেহরান, ১৯৫৬)

মুয়াবিয়া (রা.) মক্কায় সাদা প্লাস্টার আর লাল ইটের বাড়ি তৈরি করেন। বাদশাহ হারুন অর রশিদের বাড়িতে কাচ ও মোজাইক ব্যবহার করা হয়। ইবনে খালদুন বলেন, দেয়ালে প্লাস্টার, মার্বেল বা কাঠের নকশাও করা হতো তখন। (মুকাদ্দিমা, পৃষ্ঠা ২৪২; আখবার মাক্কা, ১/১৭৫)

শহরে বহুতল বাড়ি ও অ্যাপার্টমেন্টের প্রচলন ছিল। নাসির খসরু তাঁর সফরনামায় কায়রোতে ১৪ তলা বাড়ি দেখার কথা বলেছেন; যেখানে শত শত মানুষের আবাস ছিল। (নাসের খসরু, সফরনামা, পৃষ্ঠা ১৪৮, দারু সাদির, তেহরান, ১৯৫৬)

মুসলিম সভ্যতার বাড়িঘরগুলো কেবল আশ্রয় নয়, ছিল সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার প্রতিচ্ছবি। এর নকশা, নির্মাণদক্ষতা আর সুবিধাগুলো দেখায় কীভাবে মুসলিমরা সাধারণ জীবনকে আরামদায়ক ও সুন্দর করেছিল।

মাকদিসি বুয়াইহি সুলতান আদুদুদ্দৌলার বাড়ির বর্ণনায় বলেন, বাড়িটা ছিল স্বর্গের প্রতিচ্ছবি—নদী, বাগান, গম্বুজ আর গ্রন্থাগারে ভরা। (আহসানুত তাকাসিম, পৃষ্ঠা ৪৪৫, দারু সাদির, বৈরুত, ১৯০৬)

এই স্থাপত্য মুসলিম সভ্যতার গৌরব ও সৃজনশীলতার কথাই বলে।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

দিরিলিসের আরতুগ্রুলের সকল পর্ব কিভাবে দেখবেন?

নিশ্চয়ই কষ্টের সাথেই স্বস্তি আছে

ড. খন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর বই Pdf Download