সন্দেহের এই যুগে সমাজে বিশ্বাস ফিরিয়ে আনার ৫ উপায়
একটা সময় ছিল, যখন গ্রামের বাড়িগুলোর দরজা খোলা থাকত। প্রতিবেশীরা একে অপরের বাড়িতে যেত, গল্প করত, সুখ-দুঃখ ভাগ করে নিত। মুখে কথাই ছিল তখন অটুট প্রতিশ্রুতি, যেন একটা অলিখিত চুক্তি। এই ‘স্বাভাবিক বিশ্বাস’ সমাজকে চলতে সাহায্য করত। বিশ্বাস ছিল তখন সমাজ-ইঞ্জিনের জ্বালানি শক্তি।
কিন্তু সময় বদলেছে। শহর বড় হয়েছে, জীবন জটিল হয়েছে। মানুষের শরীর কাছাকাছি এলেও মনের দূরত্ব বেড়েছে। ছলনা আর ভাঙা প্রতিশ্রুতির গল্পে সেই বিশ্বাসের জাল ছিঁড়তে শুরু করেছে। আমাদের মধ্যে গড়ে উঠেছে ‘সন্দেহের সংস্কৃতি’—যা কখনো কখনো যুক্তিসঙ্গত হলেও সমাজের গতিকে বারবার আটকে দেয়।
অতীতের জন্য শুধু আফসোস নয়, বরং সাহস নিয়ে ভবিষ্যৎ গড়তে হবে। আমাদের সেই পুরনো ‘স্বাভাবিক বিশ্বাস’ থেকে এগিয়ে যেতে হবে ‘সচেতন বিশ্বাস’-এর দিকে।
তাহলে কী করব? অতীতের জন্য শুধু আফসোস নয়, বরং সাহস নিয়ে ভবিষ্যৎ গড়তে হবে। আমাদের সেই পুরনো ‘স্বাভাবিক বিশ্বাস’ থেকে এগিয়ে যেতে হবে ‘সচেতন বিশ্বাস’-এর দিকে। এই নতুন বিশ্বাস হুট করে আসবে না। এটি আমাদের নিজেদের হাতে গড়তে হবে, সচেতনভাবে।
এর জন্য দরকার একটা নতুন সামাজিক চুক্তি—যার নিয়ম থাককে স্পষ্ট, নৈতিকভাবে স্বচ্ছ এবং আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গেও যার বিরোধ তাকবে না। এই চুক্তি শুধু ব্যক্তিগত সম্পর্ক নয়, আমাদের সমষ্টিগত জীবনকেও নতুন জীবন দেবে।
বিশ্বাসের চুক্তির ৫ নিয়ম
এই নতুন বিশ্বাস গড়তে আমাদের দরকার একটা স্পষ্ট চুক্তি। এগুলো শুধু নিয়ম নয়, জীবনের নীতি, যা আমাদের দৈনন্দিন কাজে প্রতিফলিত হবে।
১. স্বচ্ছতা ও স্পষ্টতা: অস্পষ্টতা না থাকলে ভুল বোঝাবুঝি কমে আসবে। আমাদের সংস্কৃতিতে স্বচ্ছতার কথা বলতে অনেকে সংকোচ করে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, স্বচ্ছতা একটা নৈতিক চুক্তির ভিত্তি। যে কাজে স্পষ্টতা নেই, তা ‘গারার’ বা অস্পষ্ট ঝুঁকি তৈরি করে। ইসলামি ফিকহে বলা হয়, এমন চুক্তি বৈধ নয়, কারণ এতে বিশ্বাস ভাঙার আশঙ্কা থাকে। (আল-সারাখসী, আল-মাবসুত, ১৫/৪৫, দার আল-মা'রিফাহ, বৈরুত, ১৯৯৩)
স্বচ্ছতা ছাড়া কোনো সম্পর্ক টেকে না।
তোমরা সবাই দায়িত্বশীল এবং সবাইকে নিজ নিজ দায়িত্বের জন্য জবাবদিহি করতে হবে।সহিহ বুখারি, হাদিস: ৭১৩৮
২. পরামর্শ করা: পরামর্শ মানে এখানে সবার সঙ্গে আলোচনা করে কাজ করার অভ্যাস করা। সামাজিক কাজে সমাজের সবাইকে জড়িয়ে নেওয়া শুধু ভালো ব্যবস্থাপনা নয়, এটা কোরআনের শিক্ষাও বটে। কোরআনে বলা হয়েছে, “তাদের সঙ্গে তাদের বিষয়ে পরামর্শ কর।” (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৫৯)
এই পরামর্শের নীতি পরিবার থেকে রাষ্ট্র—সব জায়গায় প্রযোজ্য। এটা বিশ্বাসের জালকে আরও মজবুত করে।
৩. আমানত ও দায়িত্ব: নবীজি বলেছেন, “তোমরা সবাই দায়িত্বশীল এবং সবাইকে নিজ নিজ দায়িত্বের জন্য জবাবদিহি করতে হবে।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৭১৩৮)
যিনি কোনো কাজের দায়িত্বে আছেন, তিনি শুধু বস নন, তিনি একজন আমানতদারও বটে—যার ওপর সমাজের সম্পদ, সময় আর স্বপ্নের দায়িত্ব রয়েছে। এই শিক্ষা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, নেতৃত্ব মানে অন্যদের সেবার দায়িত্ব নেওয়া। অধস্তনদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা করাও আমানত।
৪. খোঁজখবর নেওয়া ও সম্পর্ক রক্ষা: পরিচিতজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করা মানে শুধু মিটিং করা নয়। মানুষের খোঁজ নেওয়া, তাদের সঙ্গে হৃদয়ের সংযোগ রাখা, বিয়েতে অভিনন্দন জানানো, কারও মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করা—এগুলো আমাদের ঐতিহ্যের অংশ। কোরআন বলে, “তোমরা নিকটাত্মীয়তার সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা কর।” (সুরা নিসা, আয়াত: ১)
এই সংযোগ সমাজকে উষ্ণ রাখবে এবং পারস্পরিক বিশ্বাসের ভিত্তি তৈরিতে সহায়ক হবে।
৫. মর্যাদা রক্ষা করা: এটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কোরআনে বলা হয়েছে, “সুন্দর কথা ও ক্ষমা করা সেই দানের চেয়ে উত্তম, যার পরে কষ্ট দেওয়া হয়।” (সুরা বাকারা, আয়াত: ২৬৩)
কোনো কাজের ফল যতটা গুরুত্বপূর্ণ, তার ধরনও ততটাই গুরুত্বপূর্ণ। যিনি উপকার পাচ্ছেন, তার যেন কখনও অপমানিত বোধ না হয়, বরং তিনি নিয়েও যেন সম্মানিত বোধ করেন। এটা বিশ্বাসের ভিত মজবুত করবে।
বিশ্বাস থেকে সমাজের বন্ধন ও সভ্যতা গড়ে উঠবে
কেউ হয়তো ভাবতে পারে, এই সন্দেহের যুগে বিশ্বাস গড়তে এত পরিশ্রম কেন করতে হবে? কেউ তো ভালো সেজে বিশ্বাসের অপব্যবহারও করতে পারে। হ্যাঁ, ঝুঁকি আছে। কিন্তু সচেতন বিশ্বাস মানে সরল মনে সব মেনে নেওয়া নয়। সেতু বানানোর মানে পাহারা দেওয়া বন্ধ করা নয়।
অন্ধ বিশ্বাস বা অন্ধ সন্দেহ দুইটাই ক্ষতিকর। আমাদের দরকার এমন দৃষ্টিভঙ্গি, যা বোঝে যে সমাজকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে বিশ্বাসের সেতু গড়তে হবে।
তবে বিশ্বাসের ক্ষতির সঙ্গে সন্দেহের ক্ষতিটাও তুলনা করে দেখতে হবে। সন্দেহ শুধু সম্পর্ক ভাঙে তা নয়, কাজের গতি কমায়, নতুন উদ্যোগ মেরে ফেলে, আর অতিরিক্ত নিয়ম-কানুনের জটিলতায় সৃজনশীলতা হারায়।
সবচেয়ে বড় ক্ষতি? সন্দেহ আমাদের সমাজের গোষ্ঠীগত ঐক্যকে ধ্বংস করে। ইতিহাসবিদ ইবনে খালদুন বলেছেন, এই ঐক্যই একটা জাতির আত্মা, যা তাকে শক্তিশালী রাখে। এই ঐক্য ছাড়া সমাজ ভেঙে পড়ে। (ইবন খালদুন, আল-মুকাদ্দিমা, ১/৯৮-৯৯, প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি প্রেস, প্রিন্সটন, ১৯৬৭)।
অন্ধ বিশ্বাস বা অন্ধ সন্দেহ দুইটাই ক্ষতিকর। আমাদের দরকার এমন দৃষ্টিভঙ্গি, যা বোঝে যে সমাজকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে বিশ্বাসের সেতু গড়তে হবে। আমরা যে পাঁচটি স্তম্ভের কথা বললাম—স্বচ্ছতা, পরামর্শ, দায়িত্ব, সম্পর্ক, মর্যাদা—এগুলো শুধু বিশ্বাস গড়ার হাতিয়ার নয়, অপব্যবহারের ঝুঁকি কমানোর জন্যও সহায়ক।

মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন