কেয়ামতের একটি আলামত হলো ভূমিকম্প বৃদ্ধি
কেয়ামতের একটি আলামত হলো ভূমিকম্প বৃদ্ধি পাবে। প্রতি কয়েকবছর পর পরই আমরা বড় ধরণের ভূমিকম্পের খবর পাচ্ছি। এ সমস্ত প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে আমরা কোন ধরণের উইজডম (বিজ্ঞতা) আহরণ করতে পারি? কিভাবে এগুলো বুঝবো? কেন এগুলো ঘটে? এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া খুবই কঠিন। স্পর্শকাতর বিষয় এটি। তাই, আজকের সংক্ষিপ্ত আলোচনায় আমি আটটি বিজ্ঞতা তুলে ধরবো। যা আমাদের ইসলামী ঐতিহ্যে পাওয়া যায়। আমাদের ওলামা এবং ধর্মতত্ত্ববিদেরা এগুলো প্রদান করেছেন। আটটির সবগুলো যে সব পরিস্থিতিতে পাওয়া যাবে ব্যাপারটা এমন নয়। কোনো পরিস্থিতিতে হয়ত একটি, কোনো পরিস্থিতিতে দুইটি আবার কোনো পরিস্থিতিতে হয়তো সবগুলো একত্রে পাওয়া যাবে। ১। আমাদের কিছু কিছু ওলামা বলেছেন- প্রাকৃতিক দুর্যোগ মানুষকে নম্রতা শেখায়। এসব দুর্যোগের উদ্দেশ্য হলো- আল্লাহর ক্ষমতার সামনে আমাদের অসহায়ত্ব উপলব্ধি করা এবং নিজেদেরকে তাঁর নিকট বিনম্র করে দেওয়া। আমাদেরকে মৃত্যুর কথা মনে করিয়ে দেওয়া। আমাদের ভেতর থেকে অহংকার নির্মূল করা। আল্লাহ আমাদের বলেছেন- وَ لَنَبۡلُوَنَّکُمۡ بِشَیۡءٍ مِّنَ الۡخَوۡفِ وَ الۡجُوۡعِ وَ نَقۡصٍ مِّنَ الۡاَمۡوَالِ وَ الۡاَنۡفُسِ وَ الثَّمَرٰتِ - আর আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং জান-মাল ও ফল-ফলাদির স্বল্পতার মাধ্যমে। (২:১৫৫) আমি অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করবো। তোমরা তোমাদের জীবন হারাবে। সম্পদ হারাবে। জীবিকা হারাবে। ফসল হারাবে। "আর তুমি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও।" আমাদের রাসূল (স) যখনই কোনো দুর্যোগের সম্মুখীন হতেন তিনি উঠে যেতেন এবং ইবাদাত বাড়িয়ে দিতেন। বেশি বেশি নামাজ পড়তেন, দোয়ার পরিমাণ বাড়িয়ে দিতেন। তাহলে, স্পষ্টতই ডিভাইন দুর্যোগে বিজ্ঞতা রয়েছে। এটি আপনার অলস মনকে জাগিয়ে তোলে। আপনার গাফেল মনকে উদ্যমী করে তোলে। এটি আপনাকে আল্লাহর কাছাকাছি নিয়ে আসে। আপনি বেশি বেশি বেহেশত দোজখ নিয়ে চিন্তা করতে থাকেন। নিজের সসীম জীবন নিয়ে চিন্তা করতে থাকেন। আল্লাহ কুরআনে বলেছেন - فَلَوۡلَاۤ اِذۡ جَآءَهُمۡ بَاۡسُنَا تَضَرَّعُوۡا وَ لٰکِنۡ قَسَتۡ قُلُوۡبُهُمۡ وَ زَیَّنَ لَهُمُ الشَّیۡطٰنُ مَا کَانُوۡا یَعۡمَلُوۡنَ - সুতরাং তারা কেন বিনীত হয়নি, যখন আমার আযাব তাদের কাছে আসল? কিন্তু তাদের হৃদয় নিষ্ঠুর হয়ে গিয়েছে। আর তারা যা করত, শয়তান তাদের জন্য তা শোভিত করেছে। (৬:৪৩) তাহলে দেখা যাচ্ছে এখানে বিজ্ঞতা রয়েছে। যখন এরকম কিছু ঘটে মানুষের উচিত নিজেদেরকে আল্লাহর সম্মুখে বিনম্র করে দেওয়া। ২. অন্য একদল আলেমের অভিমতে, যখনই কোনো দুর্যোগ কারো উপর আপতিত হয়, এটা তার কর্মের কারণেই হয়। কুরআনে এমন কিছু আয়াত রয়েছে যেগুলোকে এ দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করা যায়। وَ مَاۤ اَصَابَكُمۡ مِّنۡ مُّصِیۡبَۃٍ فَبِمَا كَسَبَتۡ اَیۡدِیۡكُمۡ وَ یَعۡفُوۡا عَنۡ كَثِیۡرٍ - আর তোমাদের প্রতি যে মুসীবত আপতিত হয়, তা তোমাদের কৃতকর্মেরই ফল। আর অনেক কিছুই তিনি ক্ষমা করে দেন। (৪২:৩০) কেউ কেউ এই বুঝের বিপরীতে প্রশ্ন তুলেছেন। তাদের প্রশ্ন হলো, তাহলে বাচ্চাদের উপর যে শাস্তি আসে সেটা কিভাবে বুঝবো বা এমন মানুষদের উপর যারা কোনো অন্যায় করেনি। তাই কিছু উলামা বলেছেন, সকল বিপদ সর্বদা মানুষের অন্যায়ের কারণে আপতিত হয় না। কখনো কখনো হয়। কিন্তু সবসসময় নয়। আর এটাই সঠিক অভিমত। তবে, আপনি ব্যক্তি হিসেবে এভাবে চিন্তা করতে পারেন যেন আল্লাহর কাছাকাছি আসতে পারেন। "হ্যাঁ, আমি পাপ করেছি তাই আমার পাপের কারণে আমার উপর এ বিপদ আপতিত হয়েছে। আমাকে এখন সেসব পাপ থেকে তাওবা করতে হবে।" ব্যক্তিগত পর্যায়ে এভাবে চিন্তা করা ভালো। কিন্তু সমগ্র দেশ কেন্দ্রিক চিন্তা করতে গেলে বলবো, এটা সর্বদা পাপের কারণে হয় না। ৩. আরেকদল আলেমের মতে, মানুষের উপর দুর্যোগ আপতিত হয় তাদের পাপের কাফফারা হিসেবে। তাদের পবিত্র করার জন্য। তাদের পাপগুলো ধুয়ে মুছে তাদের পরিচ্ছন্ন করার জন্য। এই ব্যথা বেদনার মাধ্যমে আল্লাহ তাদের পাপগুলো মুছে দিবেন। এর প্রমান হলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই হাদিস, "মুসলিম ব্যক্তির উপর যে সকল বিপদ-আপদ আসে এর দ্বারা আল্লাহ তার পাপ দূর করে দেন। এমনকি যে কাঁটা তার শরীরে ফুটে এর দ্বারাও।" (বুখারি ও মুসলিম) ৪। এই দুর্যোগের কারণে সে যে কষ্ট পেয়েছে তার ক্ষতিপূরণ হিসেবে আল্লাহ পরকালে তাকে পুরস্কৃত করবেন। তার কষ্টের তুলনায় তাকে অনেক বেশি পুরস্কৃত করবেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম বলেছেন, "বড় বড় বিপদ-মুসীবাতের পরিণাম বড় পুরস্কার। আল্লাহ তা’আলা কোন জাতিকে ভালবাসলে তাদেরকে বিপদাপদ দিয়ে পরীক্ষা করেন। যারা এতে সন্তুষ্ট ও তৃপ্ত থাকে তাদের জন্য আল্লাহর সন্তুষ্টি রয়েছে। আর যে জাতি এতে অসন্তুষ্ট হয়, তার জন্য রয়েছে আল্লাহর অসন্তুষ্টি।" (তিরমিযী, ইবনু মাজাহ) ৫। কুরতুবি উল্লেখ করেছেন, আল্লাহ তায়ালা একটি ছোট দুর্যোগ দিয়ে বড় দুর্যোগ থেকে রক্ষা করেন। তখন ছোট দুর্যোগটাই একটি আশীর্বাদে পরিণত হয়। তিনি এর প্রমাণ হিসেবে সুরাতুল কাহাফে বর্ণিত মুসা এবং খিজির (আ) ঘটনা নিয়ে আসেন। তিনটি ঘটনার প্রতিটিই ছিল ছোট ছোট ট্রাজেডি। কিন্তু পরে দেখা যায় এর প্রত্যেকটিই ছিল আসলে আশীর্বাদ যা বড় আঁকারের দুর্যোগ থেকে রক্ষা করেছে। ৬। বায়হাকি অন্য একটি উইজডম বর্ণনা করেছেন। আধুনিক পরিভাষায় যাকে বলা হয় Educative Theodicy. অর্থাৎ, এই সমস্ত দুর্যোগে মানব জাতির জন্য শিক্ষা রয়েছে। ব্যথা বেদনার মাধ্যমে, দুর্যোগের মাধ্যমে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেন তারা কত অগণিত নেয়ামতের মধ্যে এতদিন ধরে জীবন যাপন করে আসছিল। যেগুলোকে তারা নেয়ামতই মনে করেনি। তাই, অন্যদের দুঃখ-দুর্দশা দেখে আমাদের অন্তরে এক ধরণের বিনম্রতা বোধ, এক ধরণের কৃতজ্ঞতার চেতনা তৈরি হওয়া উচিত যে, আল্লাহ আমাদের কতটা সুখে রেখেছেন। ৭। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা এক দলকে কষ্টে ফেলেন অন্যদের পরীক্ষা করার জন্য। অর্থাৎ তিনি দেখতে চান, কষ্টে পড়া মানুষদের সাহায্যে সবাই এগিয়ে আসে কিনা। তো, সত্যিকারের পরীক্ষাটা আসলে যে কষ্টে পড়ে তার জন্যে নয়, বরং এটি আশে পাশের অন্য মানুষদের জন্যে যারা কষ্টে পড়েনি, এটা দেখার জন্য যে তারা আসলে দুর্যোগে পতিত মানুষদের সাহায্যে এগিয়ে আসে কিনা। ৮। আমাদের কিছু কিছু ওলামা বলেছেন, আল্লাহর কোনো কাজকে যুক্তিযুক্ত করার চেষ্টা করা মানুষের জন্য ভুল। তাঁদের উপলব্ধিটা ছিল এরকম- প্রাকৃতিক দুর্যোগ কেন ঘটে এমন প্রশ্ন করাই ভুল। কারণ 'কেন' প্রশ্ন করার আমরা কে? এখানে বিজ্ঞতা নির্ণয় করার আমরা কে? আমাদের কি সে যোগ্যতা আছে আল্লাহর বিজ্ঞতা মূল্যায়ন করার? মালিকি মাজহাবের স্কলার ইবনে আরাবী বলেন- কেউ যদি আমাদের প্রশ্ন করে কেন এমন মনে হয় যে, আল্লাহ নিরপরাধ মানুষকে শাস্তি প্রদান করেন? আমরা এর উত্তর দিই- এর জন্য আল্লাহকে কার কাছে উত্তর দিতে হবে? কারণ তাঁর রয়েছে উচ্চতর নৈতিক কর্তৃত্ব। আল্লাহকে প্রশ্ন করার আমরা কে? এরপর তিনি কুরআনের একটি আয়াতের উদ্বৃতি প্রদান করেন- لَا یُسۡـَٔلُ عَمَّا یَفۡعَلُ وَ هُمۡ یُسۡـَٔلُوۡنَ - আল্লাহ যা করেন সে ব্যাপারে তাকে প্রশ্ন করা যাবে না; বরং তাদেরকেই প্রশ্ন করা হবে। (২১:২৩) আল্লাহ যা করেন সে ব্যাপারে আল্লাহকে প্রশ্ন করা হবে না। বরং আমরা যা করি সে ব্যাপারে আল্লাহ আমাদের প্রশ্ন করবেন। ব্যাপারটা হলো আল্লাহর চেয়ে উচ্চতর কোনো ক্ষমতার অস্তিত্ত্ব নেই। আমরা তাঁর সৃষ্টি। তাই, আল্লাহ আমাদের সাথে যাই করেন না কেন, এটা অবশ্যই ন্যায় বিচার হবে। আমরা বুঝি বা না বুঝি। আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লাকে উচ্চতর কোনো ক্ষমতার কাছে জবাব দিতে হবে না। -- ড. ইয়াসির কাদির বক্তব্য থেকে

মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন