নবীজির (সা.) আচরণ পরীক্ষা
একবার এক লোক হজরত আয়েশা (রা.)-এর কাছে এসে জিজ্ঞাসা করেন, ‘নবীজি (সা.)–এর আখলাক (চরিত্র) কেমন ছিল?’ উত্তরে তিনি বলেন, ‘তাঁর আখলাক ছিল কোরআন।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস: ২৫,৮১৩) অর্থাৎ পবিত্র কোরআনে যেমন বলা হয়েছে, তাঁর আচার-ব্যবহার ঠিক তেমনই ছিল। আর পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, নিশ্চয় আপনি মহান চরিত্রের অধিকারী। (সুরা কলম, আয়াত: ৪)
কিন্তু এখন আমরা যে গল্পটা পড়ব, এই গল্পটা বলেছেন এক ইহুদি। যিনি পরে নবীজি (সা.)–এর আচরণ দেখে ইসলাম গ্রহণ না করে পারেননি, আল্লাহ তাঁকে হেদায়েত দিয়ে ধন্য করেছিলেন।
তিনি ছিলেন ইহুদিধর্মের একজন মস্ত বড় আলেম। তাঁদের ভাষায় যাকে বলে ‘রাবাই’। নবীজি (সা.) যখন মদিনায় হিজরত করে আসেন, তিনি তাঁকে দেখতে যান।
তাঁর নাম জায়িদ ইবনে সা’নাহ। তিনি ছিলেন ইহুদিধর্মের একজন মস্ত বড় আলেম। তাঁদের ভাষায় যাকে বলে ‘রাবাই’। নবীজি (সা.) যখন মদিনায় হিজরত করে আসেন, তিনি তাঁকে দেখতে যান। অবাক হয়ে দেখেন—ইহুদিধর্মের কিতাবে একজন নবীর যেসব গুণ লেখা আছে, সবই নবীজি (সা.)-এর মধ্যে আছে। তবে দুটো গুণ দেখা সম্ভব হয়নি। সেই দুটো গুণ হলো:
তিনি রাগ উঠলে নিজে সংযত করবেন।
কেউ মূর্খের মতো আচরণ করলে তিনি ধৈর্য ধরবেন।কিন্তু কোনো মানুষের সঙ্গে খুব ভালো করে না মিশলে তো তাঁর ধৈর্য সম্পর্কে জানা যায় না। এই জন্য জায়িদ ইবনে সা’নাহ ঠিক করলেন নবীজি (সা.)-এর দরবারে বারবার আসা-যাওয়া করবেন। তিনি সত্যিই নবী কি না, এই জিনিসটা জানা তাঁর খুব প্রয়োজন।
একদিন এক লোক এসে জানালেন দূরের এক এলাকায় দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে। অন্য এলাকা থেকে যদি খাবারের জোগান না দেওয়া হয়, তাহলে সবাই না খেয়ে মারা যাবে। লোকটি আরও বললেন, ওই এলাকার সবাই মুসলমান। যদি পারেন, তাঁদের খাবার দিয়ে সহায়তা করুন।
আলী (রা.) পাশেই বসেছিলেন। তিনি বললেন, ‘আল্লাহর রাসুল, সহায়তা করার মতো আমাদের কাছে কিছুই নেই।’ এমন সময় জায়িদ ইবনে সা’নাহ এগিয়ে গেলেন। তিনি বললেন, ‘আমি আপনাদের কাছ থেকে খেজুর কিনব, এর বিনিময়ে অগ্রিম কিছু টাকা দিতে রাজি।’
নবীজি (সা.) তাঁর সঙ্গে লেনদেনে সম্মত হলেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে ৮০ মিসকাল (২৯ ভরি) সোনা বের করে দিয়ে দেন। এই সোনার দাম আজকের বাজারে প্রায় ৫০ লাখ টাকা।
নবীজি (সা.) তাঁর সঙ্গে লেনদেনে সম্মত হলেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে ৮০ মিসকাল (২৯ ভরি) সোনা বের করে দিয়ে দেন। এই সোনার দাম আজকের বাজারে প্রায় ৫০ লাখ টাকা। নবীজি (সা.) এই স্বর্ণমুদ্রা ওই লোকটাকে দিয়ে বললেন, ‘দ্রুত তাদের সাহায্য করো।’ ওদিকে চুক্তি হলো—অমুক তারিখের মধ্যে জায়িদ ইবনে সা’নাহকে এই স্বর্ণমুদ্রার সমান দামের খেজুর দেওয়া হবে।
কিন্তু চুক্তিতে উল্লেখ করা তারিখের দুই-তিন দিন আগেই জায়িদ ইবনে সা’নাহ নবীজি (সা.)–এর দরবারে হাজির হলেন। ওই দিন এক আনসারি সাহাবি ইন্তেকাল করেছিলেন। নবীজি (সা.) ও অন্যান্য সাহাবি মাত্র জানাজা থেকে ফিরেছেন। সঙ্গীর মৃত্যুতে সবারই মন খারাপ। এমন সময় জায়িদ ইবনে সা’নাহ নবীজি (সা.)-এর জামা ধরে বললেন, ‘ওই মুহাম্মদ, আমার পাওনা খেজুর কই? তোমরা আবদুল মুত্তালিবের বংশের লোকেরা পাওনা পরিশোধে টালবাহানা করো, এটা আমার জানা ছিল না।’
তাঁর কথা শুনে ওমর (রা.) রেগে গেলেন। তিনি বললেন, ‘যদি আমি রাসুল (সা.)-এর সম্মানের বিষয়টি না ভাবতাম (অর্থাৎ যদি বেয়াদবি না হতো), তাহলে এখনই আমার তলোয়ার দিয়ে তোমার মাথা আলাদা করে ফেলতাম।’ওমর (রা.)-এর কথা শুনে নবীজি (সা.) তাঁর দিকে খুব শান্তভাবে তাকালেন। তিনি বললেন, ‘তোমার কাছ থেকে এমন আচরণ আশা করিনি। তুমি এভাবে না বলে আমাকে বলতে পারতে—আপনি তাঁর ঋণ পরিশোধ করুন। কিংবা তাঁকে বলতে পারতে—আপনি সুন্দরভাবে কথা বলুন।’
তারপর বললেন, ‘ওমর, ওনাকে নিয়ে যাও। ওনার সব পাওনা পরিশোধ করো, সঙ্গে বিশ সা’ (৩২ কেজি) বেশি দিয়ো, কারণ তুমি ওনাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছ।’
ওমর (রা.) ঠিক তা-ই করলেন। জায়িদ ইবনে সা’নাহ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘পাওনার চেয়ে বেশি খেজুর কেন দিচ্ছ?’ ওমর (রা) বললেন, ‘আল্লাহর রাসুল (সা.) আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন। কারণ, আমি তোমাকে হুমকি দিয়েছিলাম।’
কোনো আলেম তো জাহেলের মতো আচরণ করতে পারেন না। এই জন্য ওমর (রা.) বেশ অবাক হলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তাহলে তুমি রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে এভাবে কেন কথা বললে?
জায়িদ ইবনে সা’নাহ বললেন, ‘হে ওমর, আপনি আমাকে চেনেন?’
ওমর (রা.) বললেন, ‘না, তুমি কে?’
তিনি বললেন, ‘আমি জায়িদ ইবনে সা’নাহ।’
ওমর (রা.) বললেন, ‘তুমি সেই বিখ্যাত ইহুদি রাবাই?’
জায়িদ ইবনে সা’নাহ বললেন, ‘জি।’
ইহুদি হলেও তো তিনি একজন আলেম। কোনো আলেম তো জাহেলের মতো আচরণ করতে পারেন না। এই জন্য ওমর (রা.) বেশ অবাক হলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তাহলে তুমি রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে এভাবে কেন কথা বললে, এমন আচরণ কেন করলে?’
জায়িদ ইবনে সা’নাহ তখন তাঁর এই আচরণের আসল কারণ বর্ণনা করলেন। তিনি পরীক্ষা নিতে চেয়েছিলেন—হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মধ্যে একজন নবীর সব আখলাক আছে কি না। এরপর জায়িদ ইবনে সা’নাহ বললেন, ‘হে ওমর, তুমি সাক্ষী থাকো—আমি আল্লাহকে আমার রব হিসেবে, ইসলামকে আমার ধর্ম হিসেবে এবং মুহাম্মদ (সা.)–কে আমার নবী হিসেবে মেনে নিলাম। আমার অনেক সম্পদ আছে। আমি আমার অর্ধেক সম্পদ মুহাম্মদ (সা.)-এর সব অনুসারীর জন্য সদকা করে দিলাম।’
ওমর (রা.) বললেন, ‘তুমি তো সবাইকে সামলাতে পারবে না।’
জায়িদ ইবনে সা’নাহ (রা.) বললেন, ‘তাহলে কতক অনুসারীর জন্য দিলাম।’
জায়িদ ইবনে সা’নাহ (রা.) পরে তাবুক যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি সেই যুদ্ধে শহীদ হয়ে আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যান। (আল মুসতাদরাক আলাস সহিহাইন, হাদিস: ৬,৬০৬; সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস: ২৮৮)
mawlawiashraf@gmail.com
মওলবি আশরাফ: লেখক, অনুবাদক ও সম্পাদক

মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন