মুসলিম বিবাহে ‘কুফু’ অর্থ কী
‘কুফু’ আরবি শব্দ, যার অর্থ হলো সমমর্যাদা, সমপর্যায়ের ব্যক্তি বা যোগ্য সঙ্গী। ইসলামি শরিয়তের ভাষায়, বিবাহে উভয় পক্ষের সামাজিক, ধর্মীয় ও নৈতিক সামঞ্জস্য বোঝাতে ‘কুফু’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়।
অর্থাৎ ইসলামে বিবাহ শুধু আকস্মিক বন্ধন নয়—এটি একধরনের মানসিক, সামাজিক ও আধ্যাত্মিক সামঞ্জস্যের সম্পর্ক, যেখানে উভয়ের বিশ্বাস, চরিত্র এবং জীবনযাপনের ভিত্তি কাছাকাছি হওয়া কাম্য। (ইবনে মানজুর, লিসানুল আরব, ৯/৮০, দারুস সদর, বৈরুত, ১৯৯০)
কোরআনে কুফু
কোরআনে সরাসরি ‘কুফু’ শব্দটি এসেছে সুরা ইখলাসে, ‘ওয়ালাম ইয়াকুন লাহু কুফুওয়ান আহাদ।’ অর্থ: ‘তাঁর সমতুল্য (কুফু) কেউ নেই।’ (সুরা ইখলাস, আয়াত: ৪)
এখানে ‘কুফু’ শব্দটি দ্বারা বোঝানো হয়েছে, আল্লাহর সমকক্ষ কেউ নেই, অর্থাৎ তিনি তুলনাহীন।
তবে সামাজিক প্রেক্ষাপটে এই শব্দটি ব্যবহৃত হয় সমতার অর্থে, যেমন ধর্ম, বংশ, চরিত্র, পেশা ও আর্থিক অবস্থায় মিল থাকা।
নারীকে চার কারণে বিবাহ করা হয় তার সম্পদ, বংশ, সৌন্দর্য এবং ধর্ম; তুমি ধর্মভীরু নারীকে বেছে নাও, তুমি সফল হবে।সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫০৯০
ইসলামি শরিয়তে কুফু
ইসলামি ফিকহ অনুযায়ী, কুফু মূলত বিবাহে সমমর্যাদা বজায় রাখার নীতিমালা। এর উদ্দেশ্য হলো,
দাম্পত্য জীবনে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করা
সামাজিক অসামঞ্জস্য থেকে বিরোধ কমানো
নারী ও তার অভিভাবকের সম্মান রক্ষা করা
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘নারীকে চার কারণে বিবাহ করা হয় তার সম্পদ, বংশ, সৌন্দর্য এবং ধর্ম; তুমি ধর্মভীরু নারীকে বেছে নাও, তুমি সফল হবে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫০৯০; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৪৬৬)
এ হাদিসে ধর্মভীরুতা বিষয়টিকে ‘কুফু’-এর সর্বোচ্চ মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।
কুফুর ধরন
ফকিহগণ কুফুকে কয়েকটি দিক থেকে বিশ্লেষণ করেছেন।
১️. ধর্মীয় কুফু: উভয় পক্ষের বিশ্বাস, নামাজ-রোজা, ইসলামি নীতি মেনে চলা ইত্যাদিতে মিল থাকা। একজন ধার্মিক নারী যেন অধার্মিক পুরুষের অধীনে কষ্ট না পান, এটি শরিয়তের মূল উদ্দেশ্য। (ইমাম নববি, আল-মাজমু’, ১৬/২৪০, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১৯৯৭)
২️. বংশগত কুফু: সমাজে বংশ ও পরিবারগত মর্যাদায় অতিরিক্ত পার্থক্য যেন না থাকে। যদিও ইসলাম বংশ নয়, ধর্ম ও চরিত্রকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে আল্লাহর নিকট সে-ই সবচেয়ে মর্যাদাবান, যে সবচেয়ে পরহেজগার।’ (সুরা হুজুরাত, আয়াত: ১৩)
৩️. নৈতিক কুফু: চরিত্র, আচার-ব্যবহার, সততা ও আচরণে সামঞ্জস্য থাকা। একজন ন্যায়পরায়ণ নারী যেন দুরাচার স্বামীর কাছে না পড়ে, এটাই মূল দর্শন। (ইবনে কুদামাহ, আল-মুগনি, ৯/৩৯০, মাকতাবাতুল কাহিরা, ১৯৮৩)
৪️. আর্থিক কুফু: স্বামী যেন স্ত্রীর প্রাপ্য রক্ষণাবেক্ষণ (নাফাকা) দিতে সক্ষম হন। ইসলামে স্ত্রীর আর্থিক অধিকার রক্ষা করা ফরজ, তাই আর্থিক সক্ষমতা কুফুর অংশ। হাদিসে এসেছে, ‘তোমাদের প্রত্যেকেই অভিভাবক এবং প্রত্যেককে তার অধীনস্থদের ব্যাপারে জবাবদিহি করতে হবে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৪২৫)
বিবাহে কুফু কি বাধ্যতামূলক
এ প্রশ্নে ফকিহদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে।
১. হানাফি ফকিহগণ বলেন, কুফু শর্ত নয় (ফরজ নয়), তবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ (মুস্তাহাব বা ইস্তিহসান)। নারীর অভিভাবক চাইলে অযোগ্য ব্যক্তির সঙ্গে বিবাহ রোধ করতে পারেন, কিন্তু যদি বিবাহ হয়ে যায়, তা বৈধ হবে, বাতিল নয়। (ইমাম সারাখসি, আল-মাবসুত, ৫/২৪, দারুল মারিফা, বৈরুত, ১৯৯৩)
২. শাফেয়ি ও হাম্বলি মতে, কুফু বিবাহের বৈধতার জন্য শর্ত নয়, বরং সামাজিক ভারসাম্যের জন্য সুপারিশকৃত। তবে ‘ধর্মীয় কুফু’ ছাড়া অন্য কোনো কুফু না মানলেও বিবাহ বাতিল হয় না। (ইমাম নববি, আল-মাজমু’, ১৬/২৪০, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১৯৯৭)
৩. মালেকি ফকিহগণ বলেন, কুফু বাধ্যতামূলক নয়, তবে অভিভাবকের অধিকার রক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত। (ইমাম ইবনু রুশদ, বিদায়াতুল মুজতাহিদ, ২/২৮, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়্যা, বৈরুত, ২০০০)
নারীর অভিভাবক চাইলে অযোগ্য ব্যক্তির সঙ্গে বিবাহ রোধ করতে পারেন, কিন্তু যদি বিবাহ হয়ে যায়, তা বৈধ হবে, বাতিল নয়।
কুফুর প্রয়োগ
ইসলাম কুফুর নীতি দিয়েছে সমাজের স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্য, কিন্তু এটি বাধ্যতামূলক নয়; বরং পরামর্শমূলক ও বাস্তববোধসম্পন্ন নির্দেশনা। অর্থাৎ যদি দুজনের মধ্যে ধর্মীয় ও চরিত্রগত সামঞ্জস্য থাকে, তবে সামাজিক মর্যাদা বা অর্থনৈতিক পার্থক্য কোনো বাধা নয়।
রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজেই জৈবিক ও সামাজিক বৈচিত্র্যময় বিবাহকে উৎসাহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘যখন এমন কেউ তোমাদের কাছে আসে, যার চরিত্র ও ধর্মীয়তা তোমাদের পছন্দ হয়, তবে তাকে বিয়ে দাও; না করলে পৃথিবীতে ফিতনা ও অরাজকতা সৃষ্টি হবে।’ (সুনান আত-তিরমিজি, হাদিস: ১০৮৪)
রাসুল (সা.) তাঁর সাহাবিদের মধ্যে এমন বহু বিবাহ সম্পন্ন করেছেন, যেখানে সামাজিক বা বংশগত পার্থক্য ছিল, কিন্তু ধর্মীয় ও চরিত্রগত মিল ছিল। যেমন জয়নব বিনতে জাহশ (রা.)-এর বিয়ে হয়েছিল জায়েদ ইবনে হারিসা (রা.)-এর সঙ্গে, জায়েদ ছিলেন মুক্ত দাস। (সুরা আহযাব, আয়াত: ৩৭)
এটি প্রমাণ করে, ইসলাম ধর্মীয় কুফুকে অগ্রাধিকার দিয়েছে, বংশ নয়।
কুফু ইসলামে কোনো শ্রেণিবৈষম্যের প্রতীক নয়, বরং বাস্তবতা ও স্থায়িত্বের নীতি। এর মাধ্যমে বিবাহিত জীবনে শান্তি, ভালোবাসা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধা বজায় থাকে।

মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন