ঈমানদারদের সালাত
সুরাতুল মু'মিনুনের শুরুতে আল্লাহ তায়ালা ঈমানদারদের অনেকগুলো বৈশিষ্ট্যের বর্ণনা দিয়েছেন। একটি বৈশিষ্ট্য হলো— তারা তাদের নামাজে খুশু বজায় রাখে। এখানে একটি ব্যাপার লক্ষ্য করুন। আল্লাহ খুশু বর্ণনা করতে ক্রিয়াপদ ব্যবহার করেননি। তিনি নাউন বা বিশেষ্য ব্যবহার করেছেন। নাউন দ্বারা কী বুঝানো হয়? স্থায়িত্ব। তারা তাদের ঈমানের ক্ষেত্রে এমন একটি পরিপক্কতায় পৌঁছে গেছে যে, প্রতিবারই যখনি তারা নামাজ আদায় করে, তখন খুশু সেই নামাজের একটি স্থায়ী বৈশিষ্ট্য হয়। এখন, আমার আপনার জন্য হয়তো আমাদের নামাজের সমগ্র সময়টাতে ওযু একটি স্থায়ী বৈশিষ্ট্য, কিবলার দিকে মুখ করে থাকাটা একটি স্থায়ী বৈশিষ্ট্য। সম্ভবত খুশু একটি স্থায়ী বৈশিষ্ট্য নয়। আমার প্রতিটি নামাজে। এখন চলুন, খুশু কী তা জানার চেষ্টা করি। আরবি 'খাসাআ'—যেখান থেকে খুশু শব্দটি এসেছে—মানে, যখন আপনি এতটাই ভীত হয়ে পড়েন, যে ভয় আপনাকে এতোটাই অভিভূত করে ফেলে যে, আপনার পেশীগুলো অসাড় হয়ে পড়ে। একটি উদাহরণ থেকে বিষয়টা বুঝি। মনে করুন, কেউ একজন একদিকে তাকিয়ে রাস্তা পার হচ্ছে আর সে বুঝতে পারেনি যে, অন্যদিক থেকে দ্রুত গতিতে একটি ট্রাক তার দিকে ছুটে আসছে। সে মুখ ঘুরিয়ে দেখে যে ট্রাকটি ঠিক তার সামনে!! ট্রাজেডি ঘটার ঠিক কয়েক সেকেন্ড পূর্বে তার মুখের অবস্থা এবং ঘটনার আকস্মিকতায় যে সে পুরোপুরি ক্ষমতাহীন হয়ে পড়েছিলো—এটা এক ধরণের খুশু। আপনি সম্পূর্ণরূপে বশীভূত হয়ে পড়েন। এটাই এ সমস্ত মুমিনদের অবস্থা। তারা নামাজে দাঁড়ালে আল্লাহর ভয়ে একেবারে অক্ষম হয়ে পড়ে, বশীভূত হয়ে পড়ে, নিজেকে সম্পূর্ণরূপে সমর্পন করে দেয়। সূরাতুল আ'রাফে বনি ইসরাইলের একটি ঘটনার কথা এসেছে। বনি ইসরাইলের নেতৃবৃন্দ মূসা (আ) এর সাথে আসেন। আর আল্লাহ এখন তাদের উদ্দেশ্যে একটি বক্তব্য দিবেন। যেন আল্লাহর কথাগুলো তারা খুবই গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করে এজন্য আল্লাহ একটি পর্বতকে তুলে নিয়ে তাদের মাথার উপর ঝুলিয়ে রাখেন। যেন এক খণ্ড মেঘ। ভাবতে পারেন? তখন তাদের মনের অবস্থা কেমন ছিল? তারা কতটা ভীত বিহ্বল হয়ে পড়েছিল! এর নাম খুশু। আল্লাহ বলছেন মুমিনরা এরকম খুশুর অনুভূতি লাভ করে কোথায়? বিশেষ করে তাদের নামাজে। আমি এখানে বিশেষ করে যোগ করছি, আরবি ব্যাকরণের নিয়মের কারণে। এর দ্বারা ইঙ্গিত করা হচ্ছে, এই ভয়ের অনুভূতি শুধু নামাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। হয়তো বাহিরে এটা স্থায়ী অনুভূতি নয়। কিন্তু নামাজের সময়টাতে এটি একটি স্থায়ী অনুভূতি। এখন দেখুন, এরকম অনুভূতি নিয়ে যদি একবার আল্লাহর কাছে হাজিরা দিতে যান, তাহলে এর প্রভাব কয়েক ঘন্টা বহাল থাকবে। এরপর পরবর্তী নামাজে আবার এরকম অনুভূতি নিয়ে হাজিরা দিলে আবার এর প্রভাব আরো কয়েক ঘন্টা বহাল থাকবে। দুই নামাজের মাঝখানের সময়গুলোতে এভাবে নামাজের প্রভাব পড়ার কথা। সালাত আসলে দুটি অনুভূতির সমষ্টি। আনন্দ এবং দুঃখ। আনন্দ কারণ আমি আমার রবের সাথে কথা বলছি। আর দুঃখিত কারণ "ইয়া আল্লাহ! আমি কিছু ভুল করে ফেলেছি। ইয়া আল্লাহ! আমাকে মাফ করে দিন। " আমাদের নামাজগুলো যেরকম হওয়ার কথা তার থেকে আমরা কত দূরে!! দ্বিতীয় যে বৈশিষ্ট্যটি বর্ণনা করা হয়েছে তা হলো— وَ الَّذِیۡنَ هُمۡ عَنِ اللَّغۡوِ مُعۡرِضُوۡنَ - "আর যারা অনর্থক কথাকর্ম এড়িয়ে চলে।" আরবিতে اللغو মানে এমন কর্মকাণ্ড যা দুনিয়াবী দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো উপকার তৈরী করে না এবং যা পারলৌকিক দৃষ্টিকোণ থেকেও কোনো উপকার তৈরী করে না। এটা সাধারণত কথাবার্তা কিন্তু অন্য কার্যক্রমও হতে পারে। যেমন, বসে বসে অযথা কথা বলে সময় নষ্ট করা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা জিহ্বা চালাতে থাকলেন। যুবক বয়সে অযথা বকবক করাতে আপনি বেশ পটু থাকেন। বন্ধুদের সাথে রাত কাটাতে চলে গেলেন। "বুঝতে পারছি না কিভাবে রাতটা পার হয়ে গেল!" বন্ধুদের সাথে কথা বলতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু সারাক্ষণ বকবক করা!! ফোনটা তুলেই — দোস্ত জানিস কি হয়েছে? ঐ লোকটা কি করেছে? — ও তাই নাকি? বল তো কি হয়েছে। এভাবে শুরু হয়ে গেলো। ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এই মানুষগুলো যারা আল্লাহর সাথে কথা বলার একটি সুন্দর সম্পর্ক গড়ে তুলেছে, তারা কথার মূল্য বুঝতে পারে। তারা বুঝতে পারে আমাদের জিহ্বা ব্যবহার করতে পারার সামর্থ্যটা যে কত বড় একটি ব্যাপার! অন্য প্রাণীদের তো এই সামর্থ্য নেই। (আল্লাহ নিজেই এ ব্যাপারটি কুরআনে তুলে ধরেছেন। তিনি সুরাতুর রাহমানে বলেন— عَلَّمَهُ الۡبَیَانَ - তিনিই মানুষকে ভাষা শিখিয়েছেন।) তাই, মুমিনরা ইচ্ছে করেই অর্থহীন কথাবার্তা এড়িয়ে চলে। তারা এমনকি বসে বসে অন্যদের অর্থহীন বকবকও শুনে না। তারা এ'রাদ করে অর্থাৎ তারা এদেরকে পাশ কাটিয়ে চলে। তারা এদের উপেক্ষা করে। তারা এমন পরিস্থিতি বর্জন করে চলে। আরবি اللغ দ্বারা কার্যক্রমও বুঝায় যা কোনো ধরণের উপকার তৈরি করে না। আপনি হয়ত সবসময় এগুলো থেকে বিরত থাকতে পারবেন না। কিন্তু এরকম নির্দিষ্ট কিছু কার্যক্রম আপনাকে শনাক্ত করতে হবে যা 'লাগউ' এর সহজ উদাহরণ হতে পারে। কোনো ভিডিও গেইমের প্রতিটি লেভেলে সর্বোচ্চ স্কোর করতে না পারলে যদি আপনার রাতে ঘুম না আসে তাহলে আপনার 'লাগউ' এর সমস্যা আছে। গেইমটা আপনাকে পুরোপুরি আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। যেমন, মানুষ ডাক্তারের চেম্বারের সামনে গিয়ে অপেক্ষা করছে। পাঁচটা মিনিট সময়ও ভিডিও গেইম খেলা ছাড়া ব্যয় করতে পারে না। গাড়ির পেছনে বসে বসেও মানুষ একই কাজ করে। যেকোনো কিছুর জন্য অপেক্ষা করার সময় এ কাজ করে তারা। যেকোনো ফ্রি সময় পেলেই তা এ কাজে ব্যয় করে। একজন ঈমানদার তার যেকোনো ফ্রি সময় কোন কাজে ব্যয় করার কথা? আল্লাহর জিকিরে। (শ্রেষ্ঠ জিকির চারটি: সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার।) সময়টা ব্যয়িত হওয়ার উচিত আমাদের আখিরাত গড়ার কাজে। আর দুঃখজনকভাবে আমাদের ফ্রি সময়গুলো মোবাইল ফোনের পেছনে চলে যাচ্ছে। এভাবে ভিডিও গেইমের আসক্তি নিয়ে যদি নামাজ পড়তে যান তখন নামাজেও হয়তো মনে মনে গেইম খেলছেন। নামাজে খুশু তৈরি হচ্ছে না। যদি দেখেন যে আপনি প্রচুর পরিমাণে কথা বলেন, তখন হয়তো লক্ষ্য করেছেন আপনার নামাজে কোনো খুশু নেই। একটির ফলশ্রুতিতে দ্বিতীয়টি ঘটে। আর দ্বিতীয়টি প্রথমটির প্রমাণ। যদি কথা কম বলেন তাহলে চিন্তা করার সময় পাবেন। নামাজে খুশু তৈরি হবে। আর নামাজের বাহিরে নিজের জন্য চিন্তা করার সময় পাবেন এবং এভাবে আপনি একজন চিন্তাশীল মানুষে পরিণত হবেন। - নোমান আলী খান
.jpg)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন