দারিদ্র্যের ক্ষতিকর প্রভাব, ইসলামের সমাধান
দারিদ্র্য বলতে যদিও পকেট শূন্য থাকা বোঝায়, কিন্তু এটা জীবনের মান, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সুখের ওপরও গভীর ছাপ ফেলে। ইসলামি পরিভাষায় দারিদ্র্যকে বলা হয়, যার কাছে তার মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য পর্যাপ্ত সম্পদ বা উপার্জন নেই।
কিন্তু এই দারিদ্র্য কীভাবে মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে? এটি কি শৈশব থেকেই শুরু হয়? এটি কি মানুষের মস্তিষ্কের ওপরও প্রভাব ফেলে? ইসলাম এ সমস্যার সমাধান কীভাবে দিয়েছে? আমরা এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজব।
দারিদ্র্যের প্রভাব বহুমুখী। দরিদ্র পরিবারে জন্মানো শিশুরা স্বাস্থ্য সমস্যায় বেশি ভোগে। তাদের জন্মের সময় ওজন কম হয়, যা শারীরিক ও মানসিক সমস্যার কারণ হতে পারে।
দারিদ্র্য: স্থায়ী গুণ নাকি অবস্থা
দারিদ্র্য কোনো স্থায়ী বিষয় নয়; বরং এটি একটি অবস্থা, যা অর্থনৈতিক ও সামাজিক মানদণ্ডের ওপর নির্ভর করে। সাধারণভাবে দারিদ্র্য হলো জীবনযাত্রার মান এমন একটি পর্যায়ে নেমে যাওয়া, যেখানে মৌলিক চাহিদা, যেমন খাদ্য, স্বাস্থ্যসেবা, পোশাক, শিক্ষা পূরণ করা কঠিন হয়ে পড়ে।
আন্তর্জাতিকভাবে চরম দারিদ্র্য বলা হয়, যখন কেউ দিনে এক ডলারের কম আয় করেন। এটি পরিবারের আয়ের ওপর নির্ভর করে, যা পরিবারের সদস্যদের মৌলিক চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ হয়।
বিশ্বব্যাংকের মতে, নিম্ন আয়ের দেশে বছরে ব্যক্তিপ্রতি আয় ৬০০ ডলারের কম হলে, তাকে দরিদ্র বলা হয়। এমন ৪৫টি দেশ রয়েছে, যার বেশির ভাগই আফ্রিকায়। যেখানে ১৫টি দেশে ব্যক্তিপ্রতি আয় ৩০০ ডলারের কম।
জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি জীবনযাত্রার মানের ভিত্তিতে দারিদ্র্যকে আরও বিস্তৃতভাবে সংজ্ঞায়িত করে, যা বিশ্বের ৭০টি দেশকে দরিদ্র হিসেবে চিহ্নিত করে। এমনকি ধনী দেশেও দরিদ্র আছে, যেমন আমেরিকায় ৩০ মিলিয়ন মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে, যা মোট জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ।
দারিদ্র্যের বিস্তার ও প্রভাব
দারিদ্র্যের প্রভাব গভীর ও বহুমুখী। যেমন দরিদ্র পরিবারে জন্মানো শিশুরা স্বাস্থ্য সমস্যায় বেশি ভোগে। তাদের জন্মের সময় ওজন কম হয়, যা শারীরিক ও মানসিক সমস্যার কারণ হতে পারে। তারা প্রায়ই অপুষ্টি, দৃষ্টি বা শ্রবণশক্তির সমস্যা, রক্তশূন্যতা বা রক্তে সিসার উচ্চ মাত্রার কারণে ভোগে।
এসব মস্তিষ্কের কার্যকারিতা কমিয়ে দেয়। দরিদ্র শিশুরা স্কুলে অনুপস্থিত থাকে এবং তাদের দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেশি। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে এক বিলিয়ন মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে, যার মধ্যে ৬৩০ মিলিয়ন চরম দারিদ্র্য।
যে ঋণগ্রস্ত হয়, সে কথায় মিথ্যা বলে এবং প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে।
১ দশমিক ৫ বিলিয়ন মানুষের বিশুদ্ধ পানির অভাব এবং প্রতি তিন শিশুর মধ্যে একজন অপুষ্টিতে ভুগছে। প্রতিবছর ১৩ মিলিয়ন শিশু পাঁচ বছর বয়সের আগেই মারা যায় অপুষ্টি বা দরিদ্র স্বাস্থ্যসেবার কারণে।
দারিদ্র্য ও মানুষের মস্তিষ্ক
দারিদ্র্য মানুষের মস্তিষ্কের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে, বিশেষ করে শৈশবে। গুয়াতেমালায় ১৯৬০–এর দশকে একটি গবেষণায় দেখা যায়, যেসব শিশু জন্মের প্রথম তিন বছরে পুষ্টিকর খাদ্য পেয়েছে, তারা ১ থেকে ২ সেন্টিমিটার লম্বা হয়েছে। কৈশোরে তারা পড়াশোনায় ভালো ফল করেছে। ২০০০–এর দশকে ফিরে এসে গবেষকেরা দেখেন, এই শিশুদের মধ্যে নারীরা বেশি শিক্ষিত এবং পুরুষেরা বেশি আয় করছে।
অন্যান্য গবেষণায় দেখা গেছে, অপুষ্টি শিশুদের মানসিক বিকাশে বাধা দেয়, তাদের পরীক্ষায় ফল প্রত্যাশিত হয় না। দরিদ্র ও এতিম শিশুদের মস্তিষ্কে স্নায়বিক কার্যকারিতা কম থাকে।
মস্তিষ্কের ‘অ্যামিগডালা’ অঞ্চলে অতিরিক্ত কার্যকলাপ দেখা যায়, যা ভয় বা নেতিবাচক আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে। ‘ফ্রন্টাল লোবে’ কার্যকলাপ কমে, যা সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাব ফেলে। এ ছাড়া দরিদ্রদের পর্যাপ্ত ঘুম না পাওয়ায় হৃদ্রোগের ঝুঁকি বাড়ে।
ইসলামে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াই
ইসলাম দারিদ্র্যকে ঘৃণা করে এবং এটিকে সমাজের জন্য হুমকি মনে করে। নবীজি (সা.) দারিদ্র্য থেকে আশ্রয় চেয়েছেন, ‘হে আল্লাহ, আমি কুফর, দারিদ্র্য ও কবরের আজাব থেকে তোমার কাছে আশ্রয় চাই।’ (আবু দাউদ, হাদিস: ১,৫৪৪)
আরেক হাদিসে তিনি বলেন, ‘যে ঋণগ্রস্ত হয়, সে কথায় মিথ্যা বলে এবং প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ২,৪০০)
হজরত উমর (রা.) বলেছিলেন, ‘যদি দারিদ্র্য কোনো মানুষ হতো, আমি তাকে হত্যা করতাম’।
একটি প্রাচীন প্রবাদে বলা হয়, ‘দারিদ্র্য যখন কোনো দেশে যায়, কুফর বলে, আমাকেও সঙ্গে নাও’।
দারিদ্র্য মানুষের চিন্তাশক্তি ও পরিবারের ওপর প্রভাব ফেলে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমরা দারিদ্র্যের ভয়ে সন্তান হত্যা করো না, আমরা তোমাদের ও তাদের রিজিক দেব।’ (সুরা আনআম, আয়াত: ১৫১)
দারিদ্র্য মানুষকে অসৎ কাজের দিকে ঠেলে দিতে পারে, তাই ইসলাম এর বিরুদ্ধে শক্ত পদক্ষেপ নিয়েছে।
যদি দারিদ্র্য কোনো মানুষ হতো, আমি তাকে হত্যা করতাম
ইসলাম দারিদ্র্য দূরীকরণে বাধ্যতামূলক ব্যবস্থা দিয়েছে
জাকাত: সম্পদের ২ দশমিক ৫ থেকে ৫ শতাংশ দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। ‘জাকাত কেবল ফকির, মিসকিন, এর কর্মকর্তা, যাদের হৃদয় আকৃষ্ট করা প্রয়োজন, দাসমুক্তি, ঋণগ্রস্ত, আল্লাহর পথে ও মুসাফিরদের জন্য।’ (সুরা তাওবা, আয়াত: ৬০)
জাকাত দরিদ্রদের গরিবি দূর করে এবং সমাজের বৈষম্য কমায়।
সদকা ও এতিমদের স্পনসরশিপ: ইসলাম স্বেচ্ছায় দান ও এতিম–বিধবাদের সাহায্যের ওপর জোর দেয়। ‘তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং ব্যয় করো, এটি তোমাদের জন্য কল্যাণকর। যারা নিজেদের কৃপণতা থেকে মুক্ত থাকে, তারাই সফল।’ (সুরা তাগাবুন, আয়াত: ১৬)
রাষ্ট্রের দায়িত্ব: ইসলামি রাষ্ট্র দরিদ্রদের চাহিদা মেটাতে ও ঋণ পরিশোধে সাহায্য করে। এটি সমাজে শ্রেণিবৈষম্য কমায়, যাতে কেউ বিলাসিতায় আর কেউ দারিদ্র্যে না থাকে।
ইসলাম দারিদ্র্যকে পবিত্র মনে করে না। এটি সম্পদকে আল্লাহর নিয়ামত বলে, যার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হয়। ‘তিনি কি তোমাকে এতিম অবস্থায় পাননি, তারপর আশ্রয় দিয়েছেন? তোমাকে পথভ্রষ্ট পাননি, তারপর পথ দেখিয়েছেন? তোমাকে দরিদ্র পাননি, তারপর সমৃদ্ধ করেছেন?’ (সুরা দুহা, আয়াত: ৬-৮)
দারিদ্র্য শুধু শরীর নয়, মন ও মস্তিষ্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করে। শিশুদের মানসিক বিকাশে বাধা দেয়, প্রাপ্তবয়স্কদের উদ্বেগ বাড়ায় এবং শারীরিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে।
ইসলাম দারিদ্র্যকে সমাজের জন্য হুমকি মনে করে এবং এর বিরুদ্ধে শক্তিশালী ব্যবস্থা নিয়েছে। জাকাত, সদকা ও রাষ্ট্রের সামাজিক দায়িত্বের মাধ্যমে ইসলাম দারিদ্র্য দূর করে এবং সবার জন্য ন্যায্য ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন নিশ্চিত করে।

মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন