যেমন ছিল আবু বকর (রা.)-এর বিচার

 


ইসলামের প্রথম খলিফা আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর শাসনামল ছিল খোলাফায়ে রাশিদুনের সূচনা। সে হিসেবে এর গুরুত্বও ছিল অপরিসীম। তাঁর খেলাফতকাল ছিল নবীযুগের একবারে কাছাকাছি।

তাঁর সময়ের বিচারব্যবস্থা ছিল মূলত মহানবী (সা.)-এর বিচারব্যবস্থারই সম্প্রসারণ ও সংরক্ষণ। মহানবী (সা.)-এর যুগে যা কিছু প্রমাণিত ছিল, তা হুবহু সংরক্ষণ ও কঠোরভাবে অনুসরণ করা হতো। যেমন: বিচার-সংক্রান্ত মহানবী (সা.)-এর সময়ের সমস্ত দলিল-প্রমাণ সংরক্ষণ করা এবং সে অনুযায়ী পুরোপুরি কাজ করা। সম্প্রসারিত ইসলামি সাম্রাজ্যের নতুন নতুন সমস্যার সমাধানের জন্য নতুন আইন তৈরি করা।

রাসুল (সা.)-এর যুগের মতো তাঁর শাসনামলেও বিচারবিভাগকে প্রশাসন থেকে আলাদা করা হয়নি এবং বিচারকাজের জন্য আলাদা কোনো দপ্তরও ছিল না। মদিনায় বিচারবিভাগ দেখাশোনার জন্য তিনি উমর (রা.)-কে নিযুক্ত করেছিলেন।

বিচারকার্যে শুধু উমর (রা.) নন, আরও অনেকে যুক্ত ছিলেন। খলিফা নিজেও বিচার করতেন এবং ফায়সালা দিতেন। এছাড়া রাসুল (সা.) সেসব কাজি ও গভর্নর নিয়োগ দিয়েছিলেন, তিনি তাঁদেরকে স্বপদে বহাল রাখেন। (মুস্তফা জুহাইলি, তারিখুল কাজা ফিল ইসলাম, পৃ. ১৩৪)

আবু বকর (রা.) বিচারকাজ পরিচালনায় চারটি উৎসকে মূল ভিত্তি হিসেবে সামনে রাখতেন— ১. কোরআন, ২. হাদিসে রাসুল। ৩. ইজমা অর্থাৎ, আলেম ও ফকিহ সাহাবীদের পরামর্শ ও ফাতওয়া। ৪. ইজতিহাদ অর্থাৎ, শরিয়তসম্মতভাবে নতুন বা জটিল বিষয়ে আলেম ও ফকিহদের গভীর গবেষণাভিত্তিক সিদ্ধান্ত।আবু বকর (রা.)-এর নীতি ছিল, তাঁর কাছে কোনো মামলা উত্থাপিত হলে প্রথমেই কোরআনে এর সমাধান খুঁজতেন। সেখানে নির্দেশনা পেলে সরাসরি সে অনুযায়ী ফায়সালা করতেন।

কোরআনে না পেলে হাদিসে নববি অনুসন্ধান করতেন। হাদিসেও স্পষ্ট নির্দেশনা না পেলে তিনি উপস্থিত লোকদের জিজ্ঞেস করতেন, ‘এ বিষয়ে রাসুল (সা.)-এর কোনো ফয়সালা সম্পর্কে কি তোমরা জানো?’ 

যদি কেউ নির্ভরযোগ্যভাবে কোনো হাদিস স্মরণ করিয়ে দিত, তিনি বলতেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ, আমাদের মাঝে এখনো এমন লোক আছেন, যাঁরা রাসুলের সিদ্ধান্ত মনে রেখেছেন।’

এরপর সেই ভিত্তিতেই রায় দিতেন। এতেও যদি সমাধান না পেতেন, তাহলে তিনি সাহাবীদের শুরাপরিষদের সভা ডাকতেন। এরপর তাঁদের পরামর্শ ও সম্মিলিত মতামতের ওপর ভিত্তি করেই রায় নির্ধারণ হতো।

এ থেকে বোঝা যায়, শুরার সিদ্ধান্তকে তিনি প্রায় বাধ্যতামূলক মনে করতেন। এমনকি খালিদ ইবনুল ওয়ালিদ (রা.)-কে তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘তুমি মানুষের পরামর্শ নেবে ও তাদের মতের বিরোধিতা করবে না।’ (ড. মুহাম্মদ রাওয়াস কালাজি, মাউসুআতু ফিকহি আবি বাকরিনিস সিদ্দিক, পৃ. ১৫৫-১৫৬)

বিচারকাজে খলিফা আবু বকর (রা.) সংবাদ গ্রহণ, সাক্ষ্য যাচাই এবং প্রমাণ নিশ্চিত করতে অত্যন্ত সতর্ক ছিলেন।

কাবিসা ইবনে জুয়াইব থেকে বর্ণিত আছে, এক নারী তাঁর নাতির সম্পদে নিজের অংশ দাবি করে আবু বকর (রা.)-এর কাছে এলে তিনি প্রথমে বলেন, ‘আল্লাহর কিতাবে তোমার জন্য কোনো নির্দিষ্ট অংশ পাই না; আর এ বিষয়ে রাসুল (সা.)-এর কোনো সিদ্ধান্তও আমার জানা নেই।’

এরপর তিনি উপস্থিত সাহাবীদের জিজ্ঞেস করলে মুগিরা ইবনে শুবা (রা.) বলেন, তিনি রাসুল (সা.)-কে দেখেছেন, রাসুল (সা.) একজন নানিকে সম্পদের ছয় ভাগের এক ভাগ (ষষ্ঠাংশ) দিতে দেখেছেন। আবু বকর (রা.) তাঁর কথার সাক্ষ্য চাইলেন। তখন মাসলামা (রা.) সাক্ষ্য দিলে তিনি ওই মহিলার জন্য ষষ্ঠাংশের নির্দেশ দিয়ে দেন। ( জাহাবি, তাজকিরাতুল হুফফাজ, দারুল ইলমিয়্যা, বৈরুত, ১/২)

এ ঘটনার মাধ্যমে আবু বকর (রা.)-এর বিচারনীতির একটি মূলনীতি স্পষ্ট হয়, বিচারক শুধুমাত্র ব্যক্তিগত জ্ঞানের ওপর ভরসা করে ফয়সালা দেবেন না; বরং নির্ভরযোগ্য সাক্ষ্য বা প্রমাণ থাকা আবশ্যক। তাঁর আরেকটি বক্তব্য হলো, ‘আমি যদি কাউকে এমন কোনো অপরাধে লিপ্ত দেখি, যাতে শরয়ি হদ প্রযোজ্য হয়, তবু পরিষ্কার দলিল বা সাক্ষী ছাড়া আমি শাস্তি কার্যকর করব না।’ (সাবহি মিহমাসানি, তুরাসুল খুলাফাইর রাশিদিন, দারুল ইলিম বৈরুত, পৃ. ১৮৬)আবু বকর (রা.)-এর শাসনকালে সংঘটিত কয়েকটি বিচারের রায় তুলে ধরা হলো : 

১. বেত্রাঘাতের নির্দেশ : ইমাম মালেক রাহ. নাফে থেকে বর্ণনা করেন, সাফিয়া বিনতে উবায়েদ তাঁকে বলেছেন, এক ব্যক্তিকে আবু বকর সিদ্দিকের কাছে উপস্থিত করা হয়। লোকটি একটি বাঁদির সঙ্গে ব্যভিচার করে এবং বাঁদিটি গর্ভবতী হয়ে যায়। লোকটি নিজেই দোষ স্বীকার করায় সাক্ষীর প্রয়োজন হয়নি। সে অবিবাহিত ছিল; তাই আবু বকর (রা.) তার ওপর ১০০ বেত্রাঘাত কার্যকর করেন এবং তাকে ফিদাক অঞ্চলে নির্বাসিত করেন। (মুওয়াত্তা ইমাম মালেক, কিতাব আল-হুদুদ, হাদিস: ৮৪৮)

আরেক বর্ণনায় বলা হয়েছে—বাঁদি নারীর ব্যাপারে কোনো শাস্তি দেওয়া হয়নি, কারণ তার সঙ্গে জোরপূর্বক ব্যভিচার করা হয়েছিল। পরে আবু বকর (রা.) পরিস্থিতি বিবেচনায় ওই নারীকে সেই ব্যক্তির সঙ্গেই বিবাহবন্ধনে যুক্ত করে দেন।

আবু বকর (রা.)-কে জিজ্ঞেস করা হয়, ‘কেউ যদি ব্যভিচারের পর কোনো নারীকে বিয়ের ইচ্ছা প্রকাশ করে, তখন কী করা উচিত?’ তিনি বলেন, ‘এর চেয়ে উত্তম তাওবা আর নেই; সে যেন তাকে বিয়ে করে নেয় এবং ব্যভিচারের পথ থেকে সরে আসে।’ (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, হাদিস: ১২৭৯৬)

২. প্রতিবিধানমূলক ফায়সালা: আলি ইবনে মাজিদা সাহমি (রা.) বলেন, আমি এক ব্যক্তির সঙ্গে ঝগড়ায় জড়িয়ে তার কানের একটি অংশ কেটে ফেলি। পরে আবু বকর সিদ্দিক (রা.) হজের উদ্দেশ্যে মক্কায় এলে ঘটনাটি তাঁর সামনে পেশ করা হয়। তিনি উমর (রা.)-কে লক্ষ করে বললেন, ‘উমর, এর কিসাস বা প্রতিবিধানমূলক দণ্ড সম্পর্কে তোমার ধারণা কী?’ উমর (রা.) একইভাবে তার কান কাটার কথার বললে আবু বকর বললেন, তিনি নবীজিকে বিনিময়ে একটি দাস দেওয়ার কথা বলতে শুনেছেন। (ওয়াকি, আখবারুল কাজা, ২/১০২)

৩. পিতার খরচের ভার সন্তানের ওপর: কায়েস ইবনে আবু হাজিম (রা.) বলেন, আমি আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর পাশে বসে ছিলাম। এমন সময় এক ব্যক্তি তাঁর পিতার দিকে ইঙ্গিত করে বলল, ‘হে আল্লাহর রাসুলের খলিফা! আমার এই পিতা আমার পুরো সম্পদ নিতে চান, যদিও তাঁর প্রয়োজন আছে।’ আবু বকর (রা.) পিতাকে লক্ষ করে বললেন, ‘তোমার যতটুকু প্রয়োজন, তুমি তোমার সন্তানের সম্পদ থেকে ততটুকুই নিতে পারো।’

এ কথা শুনে লোকটি বলল, ‘হে আল্লাহর রাসুলের খলিফা, রাসুল (সা.) কি বলেননি, “তুমি এবং তোমার সম্পদ তোমার পিতার জন্য?”’ জবাবে আবু বকর (রা.) বললেন, ‘আল্লাহ যা পছন্দ করেন, তুমিও তা-ই পছন্দ করো।’ অন্যান্য বর্ণনায় আছে, এখানে সম্পদ নেওয়ার উদ্দেশ্য হলো ভরণ-পোষণের খরচ, যা সন্তানের ওপর পিতার ন্যায্য অধিকার। (আস-সুনানুল কুবরা, ৭/৪৮১)

উপরের ঘটনাগুলোই সিদ্দিকি যুগে সংঘটিত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মামলার উদাহরণ। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর শাসনামলের বিচারব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য ছিল দুর্বলদের সহায়তা, মজলুমের হক আদায় এবং সমতাভিত্তিক সিদ্ধান্ত। ফায়সালা যার ব্যাপারেই হোক—খলিফা, গভর্নর বা সমাজের বড় কেউ—বিচারক নিরপেক্ষভাবে রায় দিতেন এবং তা সঙ্গে সঙ্গেই বাস্তবায়ন করা হতো। (মুস্তফা জুহাইলি, তারিখুল কাজা ফিল ইসলাম, পৃ. ১৬০)

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

দিরিলিসের আরতুগ্রুলের সকল পর্ব কিভাবে দেখবেন?

নিশ্চয়ই কষ্টের সাথেই স্বস্তি আছে

ড. খন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর বই Pdf Download