সুরা কমরে রসুল (সা.)–এর ইশারায় চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হওয়া
সুরা কমর পবিত্র কোরআনের ৫৪তম সুরা। এটি মক্কায় অবতীর্ণ। এর ৩ রুকু, ৫৫ আয়াত। কমর অর্থ চাঁদ। রাসুল (সা.)–এর নবুওয়াতের সত্য প্রমাণের জন্য কুরাইশরা চন্দ্রকে দ্বিখণ্ডিত করতে বললে মহানবী (সা.) তাঁর আঙুলের ইশারা করলে চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়। এ সুরায় বলা হয়েছে, নুহ (আ.)-এর সম্প্রদায়, আদ জাতি, লুত (আ.)-এর সম্প্রদায় এবং ফেরাউন সত্যের আমন্ত্রণ পেয়েও তা অস্বীকার করেছিল। এর পরিণতিতে তারা চিরতরে হারিয়ে যায়।
এ সুরার শুরুতেই অলৌকিক ঘটনাটি বর্ণনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর দেখানো নিদর্শন, কাফেরদের মুখ ফিরিয়ে নেওয়া এবং তাদের পরিণতি সম্পর্কে। অবিশ্বাসীরা নিদর্শন দেখলেও যে তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, এটাই তাদের চিরন্তন স্বভাব। আল্লাহ প্রাচীন উদাহরণ দিয়ে টেনে এনেছেন আদ, সামুদ ও ফেরাউনসহ নুহ (আ.) ও লুত (আ.)–এর জাতি তা অস্বীকার করার পরিণতির কথা। বিভিন্ন জাতিকে আল্লাহ বিভিন্ন উপায়ে শাস্তি দিয়েছেন। বেশির ভাগই প্রাকৃতিক শক্তি দিয়ে। তাদের পরিণতির বর্ণনা দেওয়ার পরপরই আল্লাহ বারবার বেছেন, ‘আমি এ কোরআনকে উপদেশ লাভের সহজ উৎস বানিয়ে দিয়েছি। এমতাবস্থায় উপদেশ গ্রহণকারী কেউ আছে কি?’এরপর আল্লাহ আগের জাতিগুলোর সঙ্গে বর্তমানের তুলনা টেনে আখিরাতে এর ভয়ংকর পরিণতির কথা বর্ণনা করেছেন। আল্লাহর কাছে সবার কর্মকাণ্ডেরই লিপিবদ্ধ আছে, যা সহজভাবে পরিণতি নির্ধারণ করা হবে। বিশ্বাসীদের ভালো পরিণতির কথা দিয়ে সুরার ইতি টানা হয়েছে।
সুরার শুরুতেই আছে মহানবী (সা.)-এর আঙুলের ইশারায় চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হওয়ার বিবরণ। নবীজি (সা.) তখন মক্কার অবিশ্বাসী ও ইহুদিদের একত্ববাদের দাওয়াত দিচ্ছেন। আবু জাহেলের নেতৃত্বে একদল অবিশ্বাসী ও ইহুদিরা এসে জানাল, মুহাম্মদ (সা.) যদি চাঁদকে দ্বিখণ্ডিত করে দিতে পারে তাহলে তারা আল্লাহর রাসুল হিসেবে তাঁকে মেনে নেবে।জিলহজ মাসের ১৪ তারিখ নবীজি (সা.) আল্লাহর কাছে দোয়া করে আঙুলের ইশারা করলে চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়। ইহুদিরা ইসলাম গ্রহণ করলেও অবিশ্বাসীরা তাঁর এই মোজেজাকে জাদু বলে আখ্যায়িত করে।
চাঁদ এত স্পষ্টভাবে দুই টুকরা হয়েছিল যে ওই দুই টুকরার ব্যবধানের মধ্য দিয়ে হেরা পর্বত দৃষ্টিগোচর হয়েছিল।
আবু জাহেল বলল, এটা জাদু। তাকে মক্কার বাইরে থাকা লোকেরা এসেও চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হওয়ার সংবাদ দেয়। তারপরও সে বলে, এটা জাদু।
সুরা ফাতহে মক্কা বিজয়ের সুসংবাদ
সুরা ফাতহ পবিত্র কোরআনের ৪৮তম সুরা। এ সুরা মদিনায় অবতীর্ণ। এর ৪ রুকু, ২৯ আয়াত। ফাতহ অর্থ বিজয়।
ষষ্ঠ হিজরিতে মুহাম্মদ (সা.) তাঁর ১ হাজার ৪০০ সাহাবি নিয়ে ওমরাহ পালনের জন্য মক্কার দিকে এগিয়ে গেলে হুদায়বিয়াতে কুরাইশো বাধা দেয়। তখন একটি চুক্তি করে ওই বছর কাবা শরিফ জিয়ারত না করে তাঁরা মদিনায় ফিরে যান। মক্কাবাসী চুক্তি ভঙ্গ করায় মক্কা বিজয়ের ভবিষ্যদ্বাণী দুই বছর পর অষ্টম হিজরিতে বাস্তবায়িত হয়।
কোরআনে বলা হয়েছে, ‘মুহাম্মদ আল্লাহর রাসুল। তাঁর সহচরেরা অবিশ্বাসীদের প্রতি কঠোর আর নিজেরা পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল।’ যারা বিশ্বাস করে এবং সৎ কাজ করে, আল্লাহ তাদের ক্ষমা করবেন এবং মহাপুরস্কার দেবেন। ষষ্ঠ হিজরির জিলকদ মাসে মক্কার কাফিরদের সঙ্গে সন্ধি চুক্তি সম্পাদনের পর নবী (সা.) যখন মদিনার দিকে ফিরে যাচ্ছেন, তখন সুরাটি নাজিল হয়।
আল্লাহ হুদায়বিয়ার সন্ধির আকারে নবী করিম (সা.) ও মুসলমানদের যে মক্কায় বিজয় দান করেছিলেন, তার সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে এই সুরায়। মুমিন নরনারীর জন্য জান্নাতের প্রতিশ্রুতি এবং কাফির ও মুনাফিকদের শাস্তি, হুদায়বিয়ার সন্ধিকালে নবীজির সঙ্গে উপস্থিত সাহাবিদের প্রতি আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি ঘোষণা, খায়বার বিজয়ের সুসংবাদ দেওয়া, সব ধর্মের ওপর ইসলামের বিজয় ঘোষণা রয়েছে এই সুরায়।
বুখারি ও তিরমিজিতে হজরত উমর ইবনে খাত্তাব (রা.)–এর বর্ণনায় আছে:
রাসুল (সা.) বলছেন, ‘আজ সন্ধ্যায় আমার ওপর এমন একটি সুরা অবতীর্ণ হয়েছে, যা দুনিয়া এবং তার মধ্যে যা কিছু রয়েছে, সবার চেয়ে বেশি প্রিয়।’ এরপর তিনি সুরা ফাতহর কিছু আয়াত তিলাওয়াত করেন। রাসুল (সা.) মদিনায় থাকা অবস্থায় স্বপ্ন দেখেন যে আমরা মক্কায় প্রবেশ করছি। বায়তুল্লাহ তাওয়াফ করছি। রাসুল (সা.) সাহাবিদের কাছে স্বপ্নের কথা উল্লেখ করলে তাঁরা অত্যন্ত আনন্দিত হন। কেননা তাঁরা জানতেন নবীদের স্বপ্ন সত্য হয়ে থাকে। রাসুল (সা.) ষষ্ঠ হিজরির জিলকদ মাসে সাহাবি নিয়ে ওমরাহর নিয়তে মদিনা থেকে রওনা হন। তিনি মক্কার কাছাকাছি পৌঁছালে বিশর ইবনে সুফিয়ান জানাল, ‘মক্কাবাসীরা আপনার আসার খবর পেয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তারা কিছুতেই মুসলমানদের মক্কায় প্রবেশ করতে দেবে না।’ এ কথা শুনে রাসুল (সা.) আর সামনে এগোলেন না। তিনি মক্কার অদূরে হুদায়বিয়াতে শিবির স্থাপন করলেন। সেখান থেকে উসমান (রা.)–কে পাঠালেন দূত হিসেবে। হজরত উসমান (রা.)–কে নিয়ে এই খবর ছড়িয়ে পড়ল যে তিনি শহীদ হয়ে গেছেন।
রাসুল (সা.) তখন গাছের নিচে বসে না পালাতে এবং মক্কার কাফিরদের মোকাবিলায় নিজেদের প্রাণোৎসর্গ করতে সাহাবিদের কাছ থেকে বাইয়াত নেন। বাইয়াতে অংশগ্রহণকারী সবার ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা সন্তুষ্ট হন। উসমান (রা.) নিহত হওয়ার খবরটি পরে ভুল প্রমাণিত হয়। এরপর উভয় পক্ষের মধ্যে আলোচনা-পর্যালোচনা শুরু হয়। কুরাইশদের পক্ষ থেকে আসে সুহাইল ইবনে আমর। আলাপ-আলোচনা চলতে থাকে। পরিশেষে চুক্তি সম্পাদিত হয়, ইতিহাসে যা হুদায়বিয়ার সন্ধি নামে পরিচিত।
সুরা ফাতহে সাহাবিদের কয়েকটি গুণের উল্লেখ রয়েছে। এই গুণগুলোর বর্ণনা কোরআনে যেমন আছে, তাওরাত ও ইঞ্জিলেও তেমনই আছে। গুণগুলো হলো: ১. তাঁরা কাফিরদের বিরুদ্ধে অসম্ভব কঠোর; ২. নিজেদের প্রতি সহানুভূতিশীল; ৩. রুকু-সিজদায় আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে নিয়োজিত; ৪. তাদের চেহারায় সিজদার চিহ্ন দীপ্তিমান; এবং ৫. তাঁদের দৃষ্টান্ত যেন একটি চারাগাছ, যা থেকে কিশলয় জেগে ওঠে, পরে তা পুষ্ট হয় এবং আরও পরে কাণ্ডের ওপর দৃঢ়ভাবে দাঁড়ায়—তা কৃষকের জন্য আনন্দদায়ক।
ফেরদৌস ফয়সাল
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন