ইসলামে স্বাধীনতার দর্শন

 


ইমান বা বিশ্বাস হলো ইসলামের মূল অনুষঙ্গ। ইমানের মূল কথা হলো কালেমা তাইয়েবা। পবিত্র কালেমায় এ ঘোষণাই দেওয়া হয়, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’, অর্থাৎ ‘এক আল্লাহ ব্যতীত আর কোনো মাবুদ নেই। হজরত মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসুল।’ এ ঘোষণার মাধ্যমে মুমিন ব্যক্তি মানব-দানব সব ধরনের মিথ্যা প্রভুর গোলামি থেকে মুক্ত হয়ে যায় এবং আদর্শ হিসেবে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে বরণ করে।


মানুষের মৌলিক অধিকার এবং ইসলামের মূল দর্শনই হলো স্বাধীনতা। মানুষকে মানুষের গোলামির জিঞ্জির থেকে মুক্ত করে পূর্ণ মানবিক মর্যাদা দেওয়াই ইসলামের লক্ষ্য। রাসুলুল্লাহ (সা.) শুধু দাস মুক্ত করেই থেমে থাকেননি; তিনি দাসকে সন্তানের মর্যাদা দিয়েছেন, ক্রীতদাসকে ভাইয়ের মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছেন এবং গোলামকে সেনা অধিনায়ক বানিয়েছেন। বংশানুক্রমিক দাসানুদাস আফ্রিকান কাফ্রি নিগ্রো হাবশি বিলাল (রা.)-কে মসজিদে নববির প্রধান মুয়াজ্জিনের দায়িত্ব দিয়েছেন।

দুনিয়ার সব মানুষ সমান মানবিক মর্যাদার অধিকারী। স্বাধীনতা মানুষের আত্মমর্যাদাসচেতন ও কর্তব্যপরায়ণ করে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে মানুষ! আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী থেকে, পরে তোমাদের বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অন্যের সঙ্গে পরিচিত হতে পারো। তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই ব্যক্তিই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন, যে তোমাদের মধ্যে অধিক মুত্তাকি। নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছু জানেন, সব খবর রাখেন। (সুরা-৪৯ হুজুরাত, আয়াত: ১৩)।’

জগতের সব মানুষ বাবা আদম (আ.) ও মা হাওয়া (আ.)-এর সন্তান। তাই সব মানুষ ভাই ভাই, তাদের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই। সাদা-কালো, লম্বা-খাটো—এ তো আল্লাহর সৃষ্ট প্রকৃতির অবদান। বর্ণবৈষম্য, ভাষাবৈষম্য এবং ভৌগোলিক ও নৃতাত্ত্বিক পার্থক্য মানুষে-মানুষে কোনো প্রভেদ তৈরি করে না। বিদায় হজের ভাষণে নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘কালোর ওপর সাদার প্রাধান্য নেই, অনারবের ওপর আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই।’ (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া)।

অর্থাৎ কেউ কারও ওপর প্রভুত্ব কায়েম করতে পারবে না। সবাই আল্লাহপ্রদত্ত মানবিক বিধান মেনে চলবে। কেউ কারও ওপর প্রভুত্ব ও কর্তৃত্ব করবে না। সর্বশক্তিমান আল্লাহ সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়েও মানুষকে ইহজগতে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছেন। ভালো-মন্দ, সত্য-মিথ্যা ও ন্যায়-অন্যায় বোঝার জন্য আল্লাহ মানুষকে জ্ঞান দিয়েছেন। পরকালে কর্মফল অনুসারে মানুষ জান্নাত বা জাহান্নামের অধিকারী হবে। স্বাধীনতার দাবি—দায়িত্বশীল আচরণ। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘ইসলামে জবরদস্তি নেই, সত্যাসত্য সুস্পষ্ট পার্থক্য হয়ে গেছে। যারা তাগুত, তথা অশুভ শক্তিকে অস্বীকার করে মহান আল্লাহর প্রতি ইমান আনল, তারা মজবুত হাতল দৃঢ়ভাবে ধারণ করল, যা কখনো ভাঙার নয়; আল্লাহ সর্বশ্রোতা মহাজ্ঞানী (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ২৫৬)।’ ‘আমি কি তাকে তার জন্য দুটি চক্ষু সৃষ্টি করিনি? আর জিহ্বা ও ওষ্ঠ-অধরদ্বয়? আর আমি তাকে (সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়) দুটি পথ দেখিয়েছি (সুরা-৯০ বালাদ, আয়াত: ৮-১০)।’ ‘তাকে পরীক্ষা করার জন্য আমি তাকে করেছি শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন। আমি তাকে পথনির্দেশ দিয়েছি, হয়তো সে কৃতজ্ঞ হবে, নয়তো সে অকৃতজ্ঞ হবে (সুরা-৭৬ দাহার, আয়াত: ২-৩)।’ ‘কিতাবধারীদের মধ্যে যারা কুফরি করে এবং মুশরিকরা জাহান্নামের অগ্নিতে স্থায়ীভাবে বসবাস করবে; তারাই সৃষ্টির অধম। নিশ্চয় যারা ইমান আনবে ও সৎকর্ম করবে, তারাই সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ। তাদের প্রতিপালকের কাছে তাদের জন্য পুরস্কার হিসেবে রয়েছে স্থায়ী জান্নাত; যার নিম্নদেশ দিয়ে ঝরনা প্রবাহিত হয়, সেথায় তারা চিরস্থায়ী হবে। আল্লাহ তাদের প্রতি প্রসন্ন এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট। এটি তার জন্য যে তার প্রতিপালককে সমীহ করে।’ (সুরা-৯৮ বাইয়ানাহ, আয়াত: ৬-৮)।

স্বাধীনতা সীমাহীন নয়। মানুষ ততটুকু স্বাধীন, যতটুকু অন্যের স্বাধীনতার সীমানা লঙ্ঘন না করে। মানুষ সামাজিক জীব হওয়ার কারণে তার জীবনের ব্যক্তিগত পরিসর খুবই সীমিত। ব্যক্তিস্বাধীনতার নামে এমন কাজ করা যাবে না, যা অন্যের অস্বস্তি ও বিরক্তির কারণ হয়। মনে রাখতে হবে, ব্যক্তিগত বিষয় ততক্ষণ ব্যক্তিগত থাকে, যতক্ষণ এর সঙ্গে কারও পছন্দ-অপছন্দ যোগ না হয়। যতক্ষণ এর প্রভাব ও ফলাফল ব্যক্তির নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী

যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম

Comments

Popular posts from this blog

সহজ দশটি(১০)টি জিকির!

❝সূরা হুজুরাত❞

ডায়াবেটিস রোগীর ডায়েট চার্ট