পাপ ও অন্যায় থেকে আত্ম সংবরণ
যখন মনের মধ্যে পাপ করার প্রবল ইচ্ছা জাগ্রত হয় তখন তা দমন করার জন্য করণীয় কিছু গুরুত্বপূর্ণ কার্যকর উপায়। মানুষ সৃষ্টিগতভাবে পাপ প্রবণ। শয়তান ও কু প্রবৃত্তি তাকে প্রায়ই পাপাচার, অন্যায় ও আল্লাহর নিষিদ্ধ কাজের দিকে তাড়িত করে। সব মানুষের মধ্যেই এমন পাপের মনোবৃত্তি জাগ্রত হয়। কিন্তু সফল হয় সে ব্যক্তি যে সুযোগ থাকার পরও আল্লাহর আযাবের ভয়ে পাপ ও অন্যায় থেকে আত্ম সংবরণ করে আর হতভাগ্য ও ধ্বংস প্রাপ্ত তো সে ব্যক্তি যে শয়তানের ফাঁদে পা দিয়ে কিংবা কামনা-বাসনার ডাকে সাড়া দিয়ে পাপ-পঙ্কিলতার অন্ধকারে হারিয়ে যায়। আল্লাহ তাআলা বলেন: "যে নিজের আত্মাকে (পাপ-পঙ্কিলতা থেকে) পবিত্র করে সেই সফল হয় আর যে তাকে কলুষিত করে ধ্বংস হয়।" (সূরা শামস: ও ১০)। যা হোক যখন অন্তরে অন্যায় ও পাপকাজের চিন্তা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে তখন কী করণীয় সে ব্যাপারে কিছু আইডিয়া পেশ করা হল। এগুলো থেকে এক বা একাধিক আইডিয়া কাজে লাগালে আশা করা যায় যে, মহান আল্লাহ পাপ পঙ্কিলতায় ডুবে যাওয়া থেকে রক্ষা করবেন ইনশাআল্লাহ। ১। মনে পাপের চিন্তা জাগ্রত হওয়ার সাথে সাথে ‘আউযুবিল্লাহি মিনাশ শায়ত্বানির রাজীম’ “বিতাড়িত শয়তান থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি” পাঠ করা। আল্লাহ তাআলা এ মর্মে বলেন: "আর যদি শয়তানের প্ররোচনা তোমাকে প্ররোচিত করে, তাহলে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করো।" (সূরা আ'রাফ: ২০০) ২। মনে আল্লাহর ভয় জাগ্রত করা। অর্থাৎ এই চিন্তা করা যে, আল্লাহর অবাধ্যতা করলে তিনি ক্রোধান্বিত হবেন এবং জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করবেন। আমাদের ভুলে যাওয়া উচিৎ নয় যে, পৃথিবীর কোনও মানুষ না দেখলেও আল্লাহর চোখকে কোনোভাবেই ফাঁকি দেয়া সম্ভব নয়। তিনি অবশ্যই বান্দার গোপন ও প্রকাশ্য সব কিছু দেখেন এবং প্রতিটি কর্ম সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান রাখেন। তাছাড়া আল্লাহর পক্ষ থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত আমাদের কাঁধের ফেরেশতা দ্বয় আমাদের প্রতিটি কর্ম দিনরাত অবিরামভাবে লিখে চলেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন: “অবশ্যই তোমাদের উপর তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত আছে। সম্মানিত আমল লেখকবৃন্দ। তারা জানে যা তোমরা কর।" (সূর ইনফিতার: ১০, ১১ ও ১২) ৩। মহান আল্লাহর নিকট অন্তরের পরিশুদ্ধি ও আল্লাহ ভীতির জন্য দুআ করা। যেমন: নবী সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমদেরকে দুআ শিক্ষা দিয়েছেন: اَللَّهُمَّ آتِ نَفْسِي تَقْوَاهَا وَزَكِّهَا أَنْتَ خَيْرُ مَنْ زَكَّاهَا أَنْتَ وَلِيُّهَا وَمَوْلاَهَا - اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ عِلْمٍ لاَ يَنْفَعُ وَمِنْ قَلْبٍ لاَ يَخْشَعُ وَمِنْ نَفْسٍ لاَ تَشْبَعُ وَمِنْ دَعْوَةٍ لاَ يُسْتَجَابُ لَهَا “হে আল্লাহ, তুমি আমার মনে তাকওয়া (আল্লাহ ভীতি) দান করো, আমার মনকে পবিত্র কর, তুমিই তো আত্মার পবিত্রতা দানকারী। তুমিই তো হৃদয়ের মালিক, অভিভাবক।” “হে আল্লাহ, আমি তোমার নিকট আশ্রয় চাই এমন ‘ইলম (জ্ঞান) থেকে যা কোনও উপকার দেয় না, এমন হৃদয় থেকে যা (তোমার ভয়ে) ভীত হয় না, এমন আত্মা থেকে যা পরিতৃপ্ত হয় না এবং এমন দোয়া থেকে যা কবুল করা হয় না।” (সহিহ মুসলিম, অধ্যায়: দুআ, তওবা-ইস্তিগফার হা/২৭২২) ৪। মৃত্যুর কথা স্মরণ করা। হাদিসে এসেছে, গুনাহরত অবস্থায় যদি মৃত্যু সংঘটিত হয় তাহলে কিয়ামতের দিন ঐ অবস্থায় উত্তোলন করা হবে। (আল্লাহ ক্ষমা করুন) যেমন: জাবির রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: يُبعَثُ كلُّ عبدٍ على ما مات عليه المُؤمِنُ على إيمانِه والمُنافِقُ على نِفاقِه “প্রত্যেক বান্দাকে ঐ অবস্থায় কিয়ামতের দিন উঠানো হবে যে অবস্থার উপর সে মৃত্যু বরণ করেছে। মুমিনকে উঠানো হবে ঈমানের উপর এবং মুনাফিককে উঠানো হবে নিফাকির উপর।” ( সহীহ ইবনে হিব্বান,হা/৭৩১৩) ৫। মনে রাখতে হবে,পাপের আনন্দ ক্ষণস্থায়ী কিন্তু তার ক্ষতি ও করুণ পরিণতি দীর্ঘস্থায়ী। পাপের উন্মাদনা সাময়িক কিন্তু তার অনুতাপ দীর্ঘ মেয়াদি। ৬। কুরআন তিলাওয়াত, কুরআন মুখস্থ, ইসলামী বই-পুস্তক পাঠ, নফল সালাত আদায় এবং বিভিন্ন ধরণের দুআ, জিকির, তাসবিহ, ইস্তিগফার ইত্যাদি পাঠ করা। ৭। নির্জন স্থান ত্যাগ করে মা, বাবা, ভাই, বোন, দ্বীনদার আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুদের সাথে অথবা ভালো কোনও আলেমের সান্নিধ্যে অথবা মসজিদে গিয়ে কিছু সময় অতিবাহিত করা। পরিবার থেকে দূরে থাকলে তাদের সাথে ফোনে কথা বলা বা ফোনে রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়দের খোঁজ-খবর নেয়া অথবা দীর্ঘ দিন যোগাযোগ হয় নি এমন দীনী ভাই ও বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করা। ৮। করতে ভালো লাগে এমন কোনও দুনিয়াবি উপকারী কাজ করা, শরীর চর্চা করা বা বাইরে খোলাস্থানে ঘুরতে যাওয়া। ঘরে চুপচাপ বসে বা শুয়ে থাকা ঠিক নয়। কারণ কথায় বলে: “অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা।” ৯) সিনেমা, নাটক ইত্যাদি দেখা, গান-বাদ্য শোনা বা অশ্লীল গল্প, উপন্যাস ইত্যাদি পরিত্যাগ করা। কারণ এগুলো মনের সুপ্ত বাসনা ও কু প্রবৃত্তিকে জাগ্রত করে। অনুরূপভাবে যে সব উপকরণ হাতের কাছে থাকার কারণে পাপের দিকে মন ছুটে যায় সে সব উপকরণকে ঘর থেকে বের করা বা নষ্ট করে ফেলা। ১০। পাপের দিকে মনে প্রচণ্ড ঝোঁক সৃষ্টি হলেও ধৈর্য ধারণ করা এবং নিজেকে পাপ থেকে সংবরণ ফরয। কেউ পাপের নিয়ত করার পর যদি আল্লাহর ভয়ে তা পরিত্যাগ করলে আল্লাহ তাআলা তার আমলনামায় গুনাহের পরিবর্তে সওয়াব লিপিবদ্ধ করবেন। যেমন: হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, وإنْ هَمَّ بِسَيِّئَةٍ فَلَمْ يَعْمَلْهَا كَتَبَهَا اللهُ تَعَالَى عِنْدَهُ حَسَنَةً كَامِلةً “আর সে যদি কোনও পাপ করার সংকল্প করে; কিন্তু সে তা কর্মে বাস্তবায়িত না করে তাহলে আল্লাহ তাআলা তাঁর নিকট একটি পূর্ণ নেকি লিপিবদ্ধ করে দেন।” (সহিহ বুখারী হা/৬৪৯১ ও সহিহ মুসলিম হা/১৩১) আল্লাহ আমাকে সহ প্রতিটি মুসলিমকে আল্লাহর নাফরমানী ও পাপাচার থেকে রক্ষা করেন। আমীন।
মহান আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য নিজের খেয়াল-খুশি, ইচ্ছা-আকাংখা বা কামনা-বাসনা বিসর্জন দেওয়া মুমিনদের জন্য সুখ ও সফলতার একটা মাধ্যম। মহান আল্লাহ তাআ’লা ইরশাদ করেন, তোমরা কস্মিণকালেও কল্যাণ লাভ করতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না তোমরা তোমাদের প্রিয় বস্তু থেকে আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় না কর। আর তোমরা যা কিছু ব্যয় কর, আল্লাহ তা ভালো জানেন। সুরা আলে-ইমরানঃ ৯২।
নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য কোন কিছু ত্যাগ করে, আল্লাহ তাকে তার চাইতে উত্তম কিছু দ্বারা প্রতিস্থাপন করবেন।” মুসনাদে আহমাদঃ ২২৫৬৫। শায়খ নাসির উদ্দিন আলবানী রহি’মাহুল্লাহ বলেছেন, হাদীসটির সনদ সহীহ।
নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “এই দুনিয়ার পুরোটাই হচ্ছে ভোগ-বিলাস ও আনন্দ উল্লাসের সামগ্রী। তার মাঝে সবচাইতে উত্তম সম্পদ হচ্ছে নেক ও সৎ কর্মপরায়ণ (উপযুক্ত) স্ত্রী।” সহীহ মুসলিমঃ ১৪৬৭।
এজন্যই একজন হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু আ'নহু বলেছেন, “ঈমানের পর মুমিন বান্দার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে সবচাইতে বড় নেয়ামত হচ্ছে অনুগতা, মিষ্ট ভাষী, কোমল হৃদয়ের মুমিনাহ স্ত্রী। আর শিরকের পরে বান্দার জন্য সবচাইতে বড় বিপদ হচ্ছে ধারালো জিহবার ও বদ চরিত্রের অবাধ্য স্ত্রী।”
আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন